ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) এর জন্য মজলিসে শূরার (পার্লামেন্ট) সিদ্ধান্তে বায়তুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তার সামান্য ভাতা নির্ধারণ করা হয়। এতে পরিবারের অপরিহার্য প্রয়োজন মিটতো মাত্র। কিন্তু শখ-আহ্লাদ পূরণ করার মতো কোনো সুযোগ তাতে হতো না। প্রচলিত আছে যে, তার স্ত্রীর একদিন মিষ্টান্ন খেতে ইচ্ছে হয়। তিনি খরচের টাকা থেকেই বেশ কয়েক দিনে কিছু বাঁচিয়ে মিষ্টান্ন আনতে স্বামীর হাতে টাকা তুলে দেন। খলিফাতুল মুসলিমিন কিছুক্ষণ নীরব থেকে শান্ত কণ্ঠে বলেন, 'তাহলে এর কম বেতনেই আমার পরিবারের চাহিদা মিটে যায়। তবে আর বেশি কেন?' বায়তুল মালে গিয়ে তার ভাতা থেকে সে পরিমাণ বরাদ্দ কমিয়ে দেন। তারপর মৃত্যুর আগে নিজ সম্পদ বিক্রি করে বায়তুল মাল থেকে গৃহীত ভাতা ফিরিয়ে দেয়ার অসিয়ত করে যান। বায়তুল মাল যাকে ইংরেজিতে বলে ট্রেজারি (State Treasury)। ট্রেজারি বলতে এমন স্থানকে বোঝানো হয় যেখানে রাষ্ট্রের আয় জমা রাখা হয় এবং যেখান থেকে তা ব্যয় করা হয়। ইসলামী যুগে মূলত বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠিত হয় নিম্নোক্ত আয়াত নাজিলের পর। 'তারা যদি আপনার কাছে আনফাল (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) প্রসঙ্গে প্রশ্ন করে, বলে দিন, আনফাল হলো আল্লাহ ও রাসূলের। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজেদের মধ্যকার অবস্থা সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম মান্য করো, যদি ঈমানদার হয়ে থাকো।' অর্থাৎ গনিমতের মালই পরোক্ষভাবে বায়তুল মাল। রাসূল (সা.) এর জীবদ্দশায় যতটুকু প্রচলিত ছিল তার চেয়ে খলিফাদের আমলেই বায়তুল মালের প্রচলন বা ব্যবহার ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর আবু বকর (রা.) তার খেলাফতের সময় যে কোনো অঞ্চল থেকে কোনো সম্পদ এলে তিনি তা মসজিদে নববিতে নিয়ে আসতেন এবং হকদাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। আবু বকর (রা.) এর ইন্তেকালের পর যখন ওমর (রা.) খলিফা নিযুক্ত হলেন, তিনি দায়িত্বশীলদের জড়ো করলেন এবং আবু বকর (রা.) এর বাসগৃহে প্রবেশ করলেন। তিনি বায়তুল মালের একটি ব্যাগ থেকে পড়ে যাওয়া একটি দিনার পেলেন। বস্তুত এভাবেই মুসলিমরা গোড়াপত্তন করলেন একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বায়তুল মালের, যেখানে সম্পদ জমা করা হতো এবং রেকর্ড বুক রাখা হতো, যেখান থেকে ভাতা প্রদান করা হতো এবং অধিকারপ্রাপ্তদের তাদের হক পেঁৗছিয়ে দেয়া হতো।
একবার হজরত ওমর (রা.) আবু মুসা (রা.) কে চিঠি লিখলেন, আমি চাই যে, বছরে একদিন এমন হোক যে, বায়তুল মালে একটি দিরহামও অবশিষ্ট না থাকে। বায়তুল মালের সব মাল বের করে বণ্টন করে দেয়া হোক। যাতে আল্লাহ তায়ালা পরিষ্কারভাবে জেনে নেন যে, আমি প্রত্যেক হকদারকে তার হক আদায় করে দিয়েছি। মূলত মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে পৃথিবীর শুরু থেকেই এ ব্যবস্থা চলে আসছে। তবে তার পরিধি ছিল মানুষের প্রয়োজন ও বিচরণ হিসেবে। মানুষের প্রয়োজন, বিচরণ ও কালের চক্রাবর্তে বহু পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পর বর্তমানে চলমান আমাদের এ ব্যবস্থা। যদি কোনো ব্যক্তি কাজ করতে অক্ষম হয়, তখন তার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তার ওয়ারিশদের ওপর। তবে যদি তার দায়িত্ব পালন করার মতো উপযুক্ত কাউকে না পাওয়া যায়, তখন তার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় বায়তুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর।
এ বায়তুল মালের আয়ের কিছু উৎস রয়েছে_ আনফাল, গনিমত, খারাজ, জিজিয়া, গণ-মালিকানাধীন সম্পত্তি থেকে উপার্জিত বিভিন্ন ধরনের আয়। এগুলো রাখা হয় বিশেষ বিভাগে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্পদ থেকে অর্জিত রাজস্ব, বিভিন্ন সীমান্তে সংগৃহীত শুল্ক, গুপ্তধন এবং ছোট খনির এক-পঞ্চমাংশ, বিভিন্ন ধরনের কর। জাকাত বাবদ আদায়কৃত সম্পদ। এসব উৎস থেকেই বায়তুল মাল তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগার সমৃদ্ধ হবে। অর্ধ পৃথিবীর শাসক ওমর (রা.) দেশের বাস্তব চিত্র দেখতে এবং প্রজাদের খোঁজ-খবর নিতে রাতে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। এ গল্পটি আমাদের কাছে খুব পরিচিত যে, এক রাতে তিনি এক ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ঘরে শিশুদের কান্না শুনে থমকে দাঁড়ালেন। খবর নিয়ে দেখেন, তাদের আয়-রোজগার করার মতো কেউ নেই। খাবারের অভাবে ক্ষুধার জ্বালায় তারা কাঁদছে। মা শিশুদের সান্ত্বনা দিতে পাতিলে শুধু পানি জাল দিচ্ছেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি দিশেহারা হয়ে দৌড়ে বায়তুল মালে গিয়ে আটার বস্তা কাঁধে নিয়ে ছুটলেন। নিজ কাঁধে নিতে গোলাম বহু পীড়াপীড়ি করল। কিন্তু ওমরের একটি মাত্র কথা, 'এ দায়িত্ব আমার, খোদার কাছে আমি কী জবাব দেব?' সুতরাং একটি রাষ্ট্রে বায়তুল মালের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি সুষ্ঠু বায়তুল মাল ব্যবস্থাই এনে দিতে পারে একটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র।