সেক্যুলারিস্টদের অপরাধের রাজনীতি
এবং বঙ্গীয় মুসলিম ভূমিতে আল্লাহর এজেন্ডার পরাজয়
ফিরোজ মাহবুব কামাল
www.drfirozmahboobkamal.com/blog/সেক্যুলারিস্টদের-অপরাধে/
স্বার্থপরতার রাজনীতি বনাম আখেরাতের ভয়ের রাজনীতি
অনেকেই সেক্যুলারিজমের অর্থ ভাবে, রাষ্ট্র থেকে ধর্ম ও ধর্মীয় এজেন্ডার পৃথকীকরণ। তাদের কথা, ধর্মের স্থান হবে মসজিদ-মাদ্রাসা ও জায়নামাজে, রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও আদালতে নয়। অথচ সেক্যুলারিজমের মূল এজেন্ডা এর চেয়ে ব্যাপকতর; শুধু ধর্মচর্চার স্থান সীমিত করে সেক্যুলারিজমের এজেন্ডা শেষ হয়না। বরং জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে ব্যক্তির এজেন্ডা তুলে নির্ধারণ করে দেয়। মানুষ কেন বাঁচবে, কেন লড়বে, কেন রাজনীতি করবে, কেন অর্থ ও প্রাণের কুরবানী পেশ করবে -সে ক্ষেত্রে কুর’আন যে ব্যাখ্যা পেশ করে, সেক্যুলারিস্টদের ব্যাখ্যাটি তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেক্যুলারিজমের আভিধানিক অর্থ ইহজাগতিকতা; সেক্যুলারিস্টদের চেতনায় কাজ করে পরকালের বদলে পার্থিব স্বার্থ শিকারের চেতনা। সেক্যুলারিস্টের মগজে যে ভাবনাটি সব সময় ঘুরপাক খায় তা হলো, কি করে সবাই পিছনে ফেলে সামনে এগুনো যায়।
মানব জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এজেন্ড হলো তার রাজনীতি। রাজনীতির মধ্য নিখুঁত ভাবে তার ঈমান ও বেঈমানী। বেঈমানী নামাজ-রোজায় লুকানো যায়। তাই সূদখোর, ঘুষখোর ও প্রতারকের বেঈমানী নামাজের জায়নামাজে দেখা যায় না, দেখা যায় রাজনীতির লড়াইয়ে। রাজনীতির অঙ্গণে বেঈমান ব্যক্তিটি তার পছন্দের পক্ষে খাড়া হয়ে তার নিজের পরিচয়টি স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। সেটি যেমন নির্বাচন কালে দেখা যায়, তেমনি যুদ্ধকালেও দেখা যায়। ১৯৭১’য়ের যুদ্ধে তাই বাঙালি ফ্যাসিস্ট, বাঙালি সেক্যুলারিস্ট ও বাঙালি কম্যুনিস্টদের বেঈমানী স্পষ্ট দেখা যায় পৌত্তলিক কাফির শক্তির কোলে উঠার মধ্য দিয়ে।। রাজনীতিই নির্ধারণ করে দেশে কি ধরণের মানব, সমাজ, রাষ্ট্র, বিচার ব্যবস্থা ও শিক্ষা-সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। রাজনীতির মধ্যে ধরা পড়ে ব্যক্তির বাঁচার এজেন্ডা। ধরা পড়ে সে কার খলিফা রূপে কাজ করে -সেটি।
রাজনীতিতে ঈমানদার মাত্রই কাজ করে মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা। তাই সে কখনো সার্বভৌম হয়না; নিজের স্বার্থ পূরণের জন্যও সে রাজনীতি করে না। রাজনীতি তার কাছে তার রব’য়ের এজেন্ডা পূরণের হাতিয়ার। এবং রাজনীতি তাকে দেয় আল্লাহর এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়ার মহা সুযোগ। সুযোগ সৃষ্টি করে তার রব’য়ের কাছে প্রিয়তর হওয়ার। সম্ভাবনা সৃষ্টি করে এমন কি শাহাদতের -তথা বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশের। এমন সুযোগ নামাজ-রোজা ও হ্জ্জ-যাকাতে সৃষ্টি হয়না। তাই রাজনীতির জিহাদ তার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত।
সেক্যুলারিজম ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেক্যুলারিজম জীবনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গতিপথই পাল্টে দেয়; তাতে অসম্ভব হয় জান্নাতের পথে চলা। সেক্যুলারিজম ব্যক্তিকে প্রচণ্ড স্বার্থপর করে। তখন মগজে ভর করে ব্যক্তি স্বার্থ, দলীয় স্বার্থ, গোত্রীয় স্বার্থ, পারিবারিক স্বার্থ, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ, আর্থিক স্বার্থ, রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের ন্যায় যাবতীয় পার্থিব স্বার্থ। তখন আল্লাহ তায়ালার কাছে জবাবদেহীতা ও আখেরাতের কল্যাণের ভাবনা কাজ দেয়না। এমন জবাবেহীতাশূণ্য স্বার্থপর চেতনার কারণে সেক্যুলারিস্টগণ ভয়ানক অপরাধীতে পরিণত হয়। বর্ণবাদ, জাতীয়তাবাদ এবং বর্ণবাদী ও জাতীয়তাবাদী নির্মূলের রাজনীতি জন্ম নিয়েছে বস্তুত সেক্যুলারিজমের গর্ভে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেড ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়া থেকে আব অরিজিন এবং নিউজিল্যান্ড থেকে মাওরীদের নির্মূল করেছে এই সেক্যুলার বর্ণবাদীরা। বাংলাদেশে এই সেক্যুলারিস্টগণ অবাঙালি বিহারীদের নির্মূলে নেমছিল। প্রায় দুই লাখ বিহারীকে হত্যা করেছে, হাজার হাজার বিহারী মহিলাদের ধর্ষণ করেছে এবং তাদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে দখলে নিয়েছে। মন থেকে আল্লাহর ভয় বিলুপ্ত হলে মানুষ যে হিংস্র পশুর চেয়েও অধিক নৃশংস হয় এবং চোর-ডাকাতদের চেয়েও অধিক দুর্বৃত্ত হয় -তার প্রমাণ হলো এই বাঙালি সেক্যুলারিস্টরা। বাংলাদেশের রাজনীতি তাদের দখলে যাওয়ায় তারা বাংলাদেশীদের দিয়েছে গুম, খুন,ধর্ষণ, অর্থপাচার, ব্যাংক ডাকাতি, বৈচারিক হত্যা, বিচার বহির্ভুত হত্যা, জেল-জুলুম, গণহত্যা ও আয়নাঘরের রাজনীতি।
অপর দিকে আখেরাতে জবাবদেহীতার রাজনীতির চরিত্রটি ভিন্ন। রাজনীতি তখন জিহাদে পরিণত হয়। তখন মগজে যে ভাবনাটি সবসময় কাজ করে তা হলো কি করে পাপ থেকে বাঁচা যায় এবং মহান রব’য়ের কাছে কি করে প্রিয়তর হওয়া যায় -সে ভাবনা। তখন সর্বক্ষণের তাড়না হয়, কি করে তাঁর মাগফিরাত পাওয়া যায় -সেটি। ঈমানদার তাই প্রতি মুহুর্ত বাঁচে রোজ হাশরে জবাবদেহীতার ভয় নিয়ে। ফলে তাঁর রাজনীতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং প্রতিটি কর্ম ও আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় পরকালের ভয় থেকে। এটিই হলো ঈমানদারের আধ্যাত্মিকতা। পরকালের সে ভয়ের রাজনীতি থেকেই পরিশুদ্ধি আসে ব্যক্তির কর্ম, চরিত্র ও আচরণে। এমন পরিশুদ্ধি জায়নামাজের নামাজে ও যিকরে আসে না। এজন্য যারা জিহাদে হাজির হয় তাদের চারিত্রিক পরিশুদ্ধির মানটিই ভিন্ন। হাজারো নফল নামাজ, নফল রোজা ও যিকরের মজলিসে সে পরিশুদ্ধি অর্জিত হয়না। এজন্যই বদর যুদ্ধের সাহাবীদের মর্যাদা এতো বেশী। তখন সে পরিশুদ্ধ ব্যক্তির কাছে ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন বর্ণ ও ভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমকে নিজের দ্বীনি ভাই রূপে গ্রহণ করাটি ইবাদত গণ্য হয়। কারণ, সেটিই তো আল্লাহর বিধান। সে কি সে বিধানের বিরুদ্ধে যেতে পারে? এজন্যই সে কালে যে প্যান ইসলামী ভাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল সেটি আজ কল্পনাও করা যায়না।
সেক্যুলারিজম: নিশ্চিত ব্যর্থতার পথ
সেক্যুলারিস্টরা হলো সার্বক্ষণিক শিকারী জীব; সর্বত্র শিকার খোঁজাই তাদের আজীবনের সাধনা। স্বার্থ শিকারের লক্ষ্যে অন্যদের উপর ছলে বলে হামলা করা। এমন নিজ ভাই, নিজ বোন এমন কি নিজ পিতা-মাতাও তাদের হামলা থেকে রেহাই পায়না। তাদের সকল সামর্থ্য ব্যয় হয় এবং সকল ভাবনা, কর্ম ও আচরন নিয়ন্ত্রিত হয় পার্থিব স্বার্থপ্রাপ্তির ধারণা থেকে। সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহতায়ালার দৃষ্টিতে এরাই হলো সবচেয়ে ব্যর্থ। তাদের সম্বন্ধে পবিত্র কুর’আনে বলা হয়েছে:
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِٱلْأَخْسَرِينَ أَعْمَـٰلًا ١٠٣
ٱلَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِى ٱلْحَيَوٰةِ ٱلدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا ١٠٤
অর্থ: বলুন (হে মহম্মদ), আমি কি তোমাদের এমন লোকদের ব্যাপারে বার্তা দিব -যারা তাদের কর্মে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত? এরা হলো তারা যাদের দুনিয়ার জীবনের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেছে, অথচ তারা মনে করে নিয়েছে কাজ-কর্মে তারাই ভাল করছে। -(সুরা কাহাফ, আয়াত ১০৩-১০৪)।
পবিত্র কুর’আনের উপরিউক্ত দুটি আয়াতে ঘোষিত হয়েছে সেক্যুলারিস্টদের জন্য করুণ বার্তা ও কড়া হুশিয়ারি। নিজেদের পেশাদারী সাফল্য, ধন সম্পদ বা রাজনৈতিক অর্জন নিয়ে তারা যতই গর্বিত হোক, মহান রব’য়ের কাছে সে সবের কোন মূল্য নাই। বরং তারাই হলো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। এবং তারা যে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত সেটি তারা বুঝবে জাহান্নামের আগুনে পৌঁছে। তখন তারা আফসোস করবে। তখন বুঝবে দুনিয়ায় যা কিছু অর্জন করেছিল -তা দুনিয়াতেই রয়ে গেছে; কিছুই আখেরাতে পৌঁছায়নি। বস্তুত আখেরাতে পৌঁছানো তাদের নিয়তও ছিল না। আখেরাতের কল্যাণের ভাবনা কখনোই তাদের চেতনায় স্থান পায়নি।
জীবনের সমগ্র সামর্থ্য যখন ব্যয় হয় স্রেফ পার্থিব সার্থ হাছিলের তাড়নায়, সেটিই হলো জীবনের সেক্যুলারিকরণ ( secularisation of life)। জীবন এতে জাহান্নামমুখী হয়। অপর দিকে জ্ঞান দান ও জ্ঞান সংগ্রহের মূল লক্ষ্য যখন পার্থিব জীবনের কল্যাণ সাধন, তখন সেটি জ্ঞানের সেক্যুলারিকরণ (secularisation of knowledge)। এমন জ্ঞান সাধনায় প্রচুর পার্থিব স্বার্থ সচেতনতা থাকলেও আখরাতের ব্যাপারে গভীর অন্ধত্ব থেকে যায়। তখন সে তার নিজ অন্তদৃর্ষ্টিতে রোজ হাশর, জান্নাত ও জাহান্নাম -এসবের কিছুই দেখতে পায় না। এবং যখন রাজনৈতিক লড়াই, রাষ্ট্র পরিচালনা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য হয় পার্থিব জীবনের কল্যান এবং থাকে না আখেরাতের কল্যাণের ভাবনা -সেটিই হলো রাজনীতির সেক্যুলারিকরণ (secularisation of politics)। অথচ মহান আল্লাহ তায়ালা চান, ব্যক্তি তার প্রতিটি মুহুর্ত ও তার প্রতি সামর্থ্য ব্যয় করবে আখেরাতের কল্যাণ বাড়াতে। ভাবনার ও বাঁচার এরূপ তাড়নাতে ঈমানদার ব্যক্তি মৃত্যুর আগেই নিজেকে মাগফিরাত লাভের যোগ্য করে ফেলে; এবং এভাবে যোগ্য করে জান্নাতের জন্যও। কোন দেশে এমন মানুষের সংখ্যা বাড়লে সেদেশে সুনীতি, সুশিক্ষা ও সুশাসনের জোয়ার আসে। এভাবেই রাষ্ট্রে কল্যাণকর বিপ্লব আসে। মুসলিমদের মাঝে তখন প্যান-ইসলামী সংহতি ও একতা গড়ে উঠে। তখন দেশের জনগণ পায় বর্ণ, ভাষা, গোত্র ও অঞ্চল ভিত্তিক পরিচয়ের উর্দ্ধে ঊঠার সামর্থ্য। সেরূপ এক মহা বিপ্লব এসেছিল নবীজী (সা:)’র আমলে এবং নির্মিত হয়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা। সে যুগে আরব, ইরানী, কুর্দি, তুর্কি, হাবশী ইত্যাদি নানা ভাষা, নানা গোত্র, নানা বর্ণ ও নানা অঞ্চলের মানুষ এক অখণ্ড ভূ-খণ্ডে বিশাল রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। অথচ সেক্যুলারিজম সে সামর্থ্য কেড়ে নেয়। তখন পার্থিব স্বার্থ চেতনায় খসে পড়ে ভাতৃত্বের বন্ধন। দেয়াল থেকে সিমেন্ট খসে পড়লে যেমন সে দেয়াল ভেঙে পড়ে, তেমনি মুসলিম উম্মাহ খণ্ডিত হয় প্যান ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্বের বন্ধন বিলুপ্ত হলে। তখন জেগে উঠে জাতীয়তাবাদী, গোত্রবাদী ও বর্ণবাদী ধারণা। তাতে রাষ্ট্র ভেঙে পড়ে। উম্মাহ তখন আর উম্মাহ থাকে না। মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে সেক্যুলারিজমের নাশকতা তাই ভয়ানক। সে নাশকতাতেই খণ্ডিত হয়েছে উসমানিয়া খেলাফত ও পাকিস্তান।
সেক্যুলারিস্টদের ফিতনা
ব্যক্তির কাছে নিরাপদ আশ্রয়স্থল যেমন তার গৃহ, মুসলিম উম্মাহর কাছে তেমনি হলো রাষ্ট্র। তাই ব্যক্তিকে যেমন তার নিজ গৃহের পাহারা দিতে হয়; ঈমানদারকে তেমনি মুসলিম রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা বাঁচাতে হয়। এজন্যই দেশের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা বাঁচানোর যুদ্ধকে ইসলাম পবিত্র জিহাদের মর্যাদা দেয়। একটি দেশে ইসলাম তথা মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডা কতটা প্রতিষ্ঠা পাবে -সেটি পুরাপুরি নির্ভর করে সেখানে কতটা সফল হলো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ। ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজটি ব্যর্থ হলে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাও ব্যর্থ হতে বাধ্য। তখন সে এজেন্ডা শুধু কিতাবেই থেকে যায়।
মহান রব চান, রাষ্ট্র পরিণত হোক তাঁর এজেন্ডাকে বিজয়ী করার হাতিয়ারে। কিন্তু সেক্যুলারিস্টগণ রাষ্ট্রকে সে কাজে ব্যবহৃত হতে দিতে রাজী নয়। রাষ্ট্রকে তারা নিজ দখলে রাখে এবং পরিণত করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ারে। তাই তারা মহান আল্লাহ তায়ালার শত্রু। এটিই সেক্যুলারিস্টদের ফিতনা। মহান রব’য়ের খলিফা রূপে প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হলো তাঁর রব’য়ের শত্রুদের সনাক্ত করা এবং নির্মূল করা। আল্লাহর খলিফা রূপে এটিই হলো প্রতিটি ঈমানদারে দায়। সে দায়িত্ব পালিত না হলে আল্লাহর জমিনে শয়তানের রাজত্ব কায়েম হয়। সেটিই হলো মহান রব’য়ের সাথে গাদ্দারী। এজন্যই জরুরি ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। একাজটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে, ঈমানদারের উপর ফরজ শুধু নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন নয়, বরং ফরজ হলো ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদ।
বস্তুত জিহাদের মাধ্যমে ঈমানদারগণ একাত্ম হয় মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে। যাদের জীবনে জিহাদ নাই, বুঝতে হবে তারা দূরে সরেছে ঈমানী দায়বদ্ধতা থেকে। এবং আগ্রহ নাই মহান রব’য়ের সাথে একাত্ম হওয়ায়। এটিই হলো মুনাফিকির আলামত। নবীজী (সা:)’র যুগে তারা নামাজ-রোজা আদায় সত্ত্বেও চিহ্নিত হয়েছে মুনাফিক রূপে। বস্তুত মুসলিম মাঝে জিহাদ শূণ্যতা ও বিভক্তি -এ হলো মুসলিম উম্মাহর বিপর্যয়ের সবচেয়ে বড় দুটি আলামত। তখন ব্যর্থ হয়ে যায় ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ। এতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায় মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডা। বিভক্তির নাশকতা তাই গুরুতর; এজন্যই বিভক্তি হারাম এবং ফরজ হলো একতা। অথচ শেখ মুজিব ও তার সহচরগণ পাকিস্তানের বাঙালিদের ধাবিত করেছিল বিভক্তির দিকে। হেমিলিয়নের বংশীবাদকের ন্যায় শেখ মুজিব বাঙালি মুসলিমদের ধাবিত করেছে বিভক্তির দিকে এবং পৌত্তলিক ভারতের কোলে। পৌত্তলিক শিবিরে এজন্যই মুজিব এতো প্রশংসা পায়।
তবে এক শ্রেণীর সেক্যুলারিস্ট আছে যারা নামাজ-রোাজ ও হজ্জ-যাকাত পালন করে বটে কিন্তু তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে ইসলামী এজেন্ডার প্রবেশাধিকার দিতে রাজী নয়। তাদের যুদ্ধ আল্লাহ তায়ালার ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডার বিরুদ্ধে। তাদের যুদ্ধ মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়ার বিরুদ্ধে। তারা মুসলিমের পরিচয় নিয়ে বাঁচতে চায় ইসলামের এজেন্ডার সাথে একাত্ম না হয়েই। ইসলামে এরূপ দ্বীন পালনের কোন স্থান নাই। আল্লাহর নির্দেশ: “উদখুলো ফিস সিলমে কা’ফ্ফা”; অর্থ, “ইসলামে প্রবেশ করো পূর্ণ ভাবে”। অর্থাৎ মুসলিমকে পূর্ণ ভাবে একাত্ম হতে হবে মহান আল্লাহর এজেন্ডার সাথে। তাই রাষ্ট্রের ন্যায় পৃথিবী পৃষ্ঠের সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে ইসলামী বিধানের বাইরে রেখে কখনোই ইসলাম পালনের কাজটি হয়না।
অখেরাতের ভয়কে সেক্যুলারিস্টগণ পশ্চাদপদতা বলে। আখেরাতের ভাবনাশূণ্যতাই তাদেরকে শয়তানের সৈনিকে পরিণত করে। এমন কি পৌত্তলিক কাফির শক্তির সৈনিকে পরিণত হওয়াও তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। এজন্যই একাত্তরে তারা ভারতের ন্যায় পৌত্তলিক শক্তির সহযোগীতে পরিণত হয়েছিল। চেতনায় সেক্যুলারিজম বেঁচে থাকলে তাদের মাঝে একাত্তরের ন্যায় কাফির শক্তির সহযোগী হওয়ার ইচ্ছাও বেঁচে থাকবে। মুসলিমের চেতনার মানচিত্র যদি পৌত্তলিকের ন্যায় অভিন্ন সেক্যুলার হয়, তবে সে কখনোই মুসলিম দেশের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রের রক্ষক হতে পারে না। সেক্যুলারিস্টগণ তাই শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতারও বড় শত্রু। অখণ্ড পাকিস্তানের চেয়ে হিন্দুত্ববাদীদের অখণ্ড ভারতের ধারণাটি তাদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য মনে হয়। বাংলাদেশের জন্য ভারত থেকে পৃথক মানচিত্র তাদের কাছে বেমানান মনে হয়।
আধুনিক যুগে মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ভাষা, বর্ণ, আঞ্চলিকতার নামে সবচেয়ে বড় ফিতনা ও সবচেয়ে বড় নাশকতার কাণ্ডটি ঘটিয়েছে সেক্যুলারিস্টগণ। প্রতিটি মুসলিম দেশে মুসলিমদের ইসলাম থেকে দূরে সরানোর কাজে এবং আখেরাতে জবাবদেহীতা ভুলিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এরা শয়তানের খলিফা রূপে কাজ করেছে। শয়তান চায়, মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি ও শক্তিহীনতা। সেক্যুলারিস্টগণ সে কাজটি করেছে মুসলিম উম্মাহকে ৫০টির বেশি টুকরোয় বিভক্ত করে। এদের কারণে মুসলিম দেশে বিলুপ্ত হয়েছে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়া। সেক্যুলারিস্টদের কারণেই মুসলিম দেশগুলিতে নবীজী (সা)’র প্রবর্তিত বিশুদ্ধ ইসলাম – যাতে ছিল শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র, প্যান ইসালামী মুসলিম ভাতৃত্ব, ন্যায় ও সুবিচারের প্রতিষ্ঠা, তা আজ বেঁচে নাই।
জাহান্নামীদের শাসন
সেক্যুলারিস্টগণ মুসলিমদের মহান আল্লাহ তায়ালার সৈনিকের বদলে শয়তানের সৈনিকে পরিণত করেছে। এটিই হলো তাদের সবচেয়ে বড় নাশকতা। সেটিরই দৃশ্যমান রূপ হলো, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ কালে দেড় লাখ ভারতীয় মুসলিম ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে খলিফার বাহিনীর বিরুদ্ধে ইরাক ও সিরিয়ায় গিয়ে যুদ্ধ করেছে। এবং ১৯১৭ সালে লক্ষাধিক বাঙালি মুসলিম সন্তান পৌত্তলিক ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে মিলে শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করেছে।
পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ তায়াল মানুষের চেতনাগত যে রোগটির অতিশয় নিন্দা করেছেন, সেটি হলো আখেরাতের ভয়শূন্যতা তথা সেক্যুলারিজমকে। যেমন সুরা ক্বিয়ামা’র ২০ ও ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
كَلَّا بَلْ تُحِبُّونَ ٱلْعَاجِلَةَ
وَتَذَرُونَ ٱلْـَٔاخِرَةَ
অর্থ: “কখনোই না, বরং তোমরা ভালবাস দুনিয়ার জীবনকে এবং পরিহার করেছো আখেরাতকে।” একই অভিযোগ আনা হয়েছে সুরা ইনসানে ২৭ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:
إِنَّ هَـٰٓؤُلَآءِ يُحِبُّونَ ٱلْعَاجِلَةَ وَيَذَرُونَ وَرَآءَهُمْ يَوْمًۭا ثَقِيلًۭا
অর্থ: “নিশ্চয়ই এরাই হলো তারা, যারা ভালবাসে দুনিয়ার জীবনকে এবং পিছনে পরিত্যক্ত রূপে ফেলে রাখে আখেরাতের ভারী দিনগুলোর ভাবনাকে”।
এরূপ আখেরাতবিমুখ ব্যক্তিগণ কি কখনো জান্নাত পায়? জান্নাত পেতে হলে তো মহান আল্লাহ তায়ালার খলিফা হওয়ার ন্যূনতম সামর্থ্য থাকতে হয়। সে সামর্থ্য তো সেক্যুলারিস্টদের থাকে না। তারা তো শয়তানের খলিফা। আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার বিরুদ্ধে লড়াই হলো তাদের রাজনীতি। তাদের জন্য জাহান্নামই হলো শেষ ঠিকানা। বস্তুত সেক্যুলারিস্টদের শাসনে সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো পরিণত হয় এমন জাহান্নামের বাসিন্দা উৎপাদনের বিশাল ফ্যাক্টরিতে। সে ফ্যাক্টরির অবিচ্ছেদ্য অংশ রূপে কাজ করে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য-সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি এবং মিডিয়া। তখন দেশের রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা ও মিডিয়া দখলে নেয় জাহান্নামের এই দুর্বৃত্ত মানুষগুলো। তখন ব্যর্থ হয় সভ্য রাষ্ট্র নির্মাণের প্রকল্প। সেক্যুলারিস্টদের শাসন মানেই তাই জাহান্নামীদের শাসন। বাংলাদেশীরা সে শাসন দেখেছে মুজিব ও হাসিনার শাসনামলে। তখন প্লাবন এসেছিল গুম, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চুরি ডাকাতি, ব্যাংক ডাকাতি, ভোট ডাকাতি, অর্থপাচার, হত্যা, গণহত্যা, আয়নাঘরের জুলুমের। তাই সবচেয়ে বড় ইবাদত হলো জাহান্নামীদের সে শাসন থেকে জনগণকে বাঁচানো। এটিই ইসলামে জিহাদ।