দুর্ভিক্ষ ১৯৭৪, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কৃষ্ণকাল

4,035 views
Skip to first unread message

Raza Mia

unread,
Dec 31, 2015, 1:46:45 PM12/31/15
to

দুর্ভিক্ষ ১৯৭৪, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কৃষ্ণকাল


মাছধরার জাল পড়া সেই বাসন্তী পাশে তার বোন দূর্গতী (কলাগাছের কান্ড সংগ্রহ করছে)

“একটি তিন বছরের শিশু এতই শুকনো যে, মনে হল সে যেন মায়ের পেটে থাকাকালীন অবস্থায় ফিরে গেছে। আমি তার হাতটা ধরলাম। মনে হল তার চামড়া আমার আঙ্গুলে মোমের মত লেগে গেছে। এই দুর্ভিক্ষের আর একটি ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান এই যে, বিশ্বস্বাস্থ্ সংস্থার মতে ৫০ লাখ মহিলা আজ নগ্ন দেহ। পরিধেয় বস্ত্র বিক্রি করে তারা চাল কিনে খেয়েছে।”

“সন্ধা ঘনিয়ে আসছে এবং গাড়ী আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম-এর লরীর পিছনে পিছনে চলেছে। এই সমিতি ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ জানালেন,“স্বাভাবিক সময়ে আমরা হয়ত কয়েক জন ভিখারীর মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি। কিন্তু এখন মাসে অন্ততঃ ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি- সবই অনাহার জনিত মৃত্যু।”

উপরের এই প্যারা দুটি প্রখ্যাত তথ্য-অনুসন্ধানী অষ্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক জন পিলজারের লিখা। লেখাটি ছাপা হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ১৭ই ডিসেম্বর লন্ডনের ডেইলী মিরর পত্রিকায়। তার এই কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল ১০ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে যখন কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলাট ডাটিয়া পাড়ার এক জেলেপাড়ার বস্ত্রহীন “বাসন্তি” মাছ ধরার জাল পড়ে লজ্জা ঢাকা ছবি ছাপা হয়েছিল। (যদিও এ ছবিকে একটি সাজানো নাটক বলে মন্তব্য করেন একশ্রেণীর বিশ্লেষক কিন্তু এইঘটনার মত ঘটনা যে ঘটেছে তা তো আর মিথ্যা নয়, এইসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক খুঁজে পাওয়া যাবে )

মাছধরার জাল পড়া সেই বাসন্তী পাশে তার বোন দূর্গতী (কলাগাছের কান্ড সংগ্রহ করছে)

চালের পয়সা জোগাড় করতে অনেক পিতা-মাতা কোলের সন্তানকেও বিক্রি করে দেবার মত নির্মম নিষ্ঠুর কাজ করেছে। এমনও খবর তখনকার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যাও করেছে। আজ এত বছর পরে সভ্য সমাজে এসে আমরা হয়ত এগুলো অনুভব করতে পারবো না। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো করুন ছিল।

বাস্তাবিক পক্ষে ঠিক এমনি বা এরচেয়েও খারাপ অবস্থা হয়েছে যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৭৪ এর মার্চ মাসে রংপুর জেলা থেকে শুরু হয় এই দুর্ভিক্ষ। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি চালের দাম মণ প্রতি দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ টাকার মত। অথচ স্বাধীনতার আগে মণপ্রতি চালের দাম ছিল সেইসময়কার দামের তুলনায় দশভাগ কম। এই সময়টাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে করুন সময় বলে অভিহিত করে থাকেন। এই দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে হয়ত ঘূর্ণিঝড় আর ব্রহ্মপুত্র থেকে সৃষ্ট বণ্যাকে দায়ী করা হয়। বাস্তবিক পক্ষে এর আরো কারণও ছিল মূলতঃ সেগুলোই আসল। দশ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মারা গেলেও সরকারী হিসেবে মাত্র ২৭ হাজার। দুঃখজনক।

নয়মাস ব্যাপী মুক্তিসংগ্রামে ত্রিশলক্ষ বা তার অধিক লোক মারা গেলেও জানা মতে, না খেয়ে ভাতের অভাবে বোধহয় কেউ মারা যায় নি। অথচ স্বাধীনতার চতুর্থ বছরে এসে একটা স্বাধীন সরকারের অধীনে ভাত না পেয়ে মারা গেছে প্রায় ১০ লক্ষ লোক। এই মৃতের দলে আছে অবশ্য ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ও কলেরায় মৃত্যুবরণকারী অনেকেই। যদিও তাদের মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ ঐ দুর্ভিক্ষ। সূষম খাদ্যের অভাবে মানুষ তখন অখাদ্যও খেয়েছে। এখনও অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বলে থাকেন যে, তারা নিজে চোখে দেখেছেন ডাষ্টবিনে উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্যকুটা খোঁজা মানুষ আর কুকুরের লড়াই। অনেকে এরচেয়েও খারাপ দৃশ্য দেখেছেন, যার বর্ণনা আজ প্রায় ৩৭ বছর পর এসে সুস্থ্য মানুষের পক্ষে শোনাটাই একটা নির্যাতন সরূপ।

১৭৭০ সালের ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে ভারত-ইংরেজ দ্বৈত-শাসনের কুফল আর ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ অর্থাৎ পঞ্চাশের মন্বন্তরের জন্য সম্পূর্ণ বিদেশী শাসক প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে দায়ী করলেও কিন্তু ১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষের জন্য শুধু বিদেশি শক্তিকে আর প্রকৃতিকে দায়ী করা চলে না বরং দায়ী অনেক অংশে দেশের অভ্যন্তরীন দুঃশাসন। মূলতঃ এইসময় থেকেই সরকারের উপর থেকে আওয়ামীলীগের সমর্থকদের তথা দেশবাসীর মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। দীর্ঘদিন পাকি যাতাকলে পিষ্ঠ এবং ৭১ এর রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বজনহারানো এদেশের মানুষের আশা ছিল স্বাধীন দেশে ভালো ভাবে বাঁচার। কিন্তু সরকারদলীয় কিছু লোকেদের সীমাহীন দূর্নীতি, দুঃশাসন এবং কিছু উল্লেখযোগ্য বাহিনীর অতি উৎসাহী তৎপরতায় জনগণের সেই স্বপ্ন অচিরেই হারিয়ে যায়। মানুষ রাজনীতিতে বিতশ্রদ্ধ হয় এবং আস্থা হারিয়ে ফেলে। সময়ের ফলাফলে আসা দূর্ভিক্ষ জনগণের মনোবল আরো নাজুক পরিস্থিতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। বিশ্বাসের দেয়ালে ধরে চিঁড়।

১৯৭৪ সালে ১৮ অক্টোবর বোষ্টনের ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে ডানিয়েল সাদারল্যান্ড লিখেছিলেন, “গত দুই মাসে যে ক্ষুধার্ত জনতা স্রোতের মত ঢাকায় প্রবেশ করেছে,তাদের মধ্যে সরকারের সমর্থক একজনও নেই। বন্যা আর খাদ্যাভাবের জন্য গ্রামাঞ্চল ছেড়ে এরা ক্রমেই রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে সরকার এদেরকে রাজপথের ত্রিসীমানার মধ্যে ঢুকতে না দিতে বদ্ধপরিকর। এরই মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যককে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে সারাদিন দুই এক টুকরা রুটি খেতে পাওয়া যায, মাঝে মাঝে দুই-একটা পিঁয়াজ ও একটু-আধটু দুধ মেলে। ক্যাম্পে ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। “যে দেশে মানুষকে এমন খাঁচাবদ্ধ করে রাখা হয় সেটা কি ধরনের স্বাধীন দেশ”- ক্রোধের সাথে বলল ক্যাম্পবাসীদেরই একজন। ক্যাম্পের ব্লাকবোর্ডে খড়িমাটি দিয়ে জনৈক কর্মকর্তা আমার সুবিধার্থে প্রত্যেকের রুটি খাওয়ার সময়সূচীর তালিকা লিখে রেখেছেন। “তালিকায় বিশ্বাস করবেন না”-ক্যাম্পের অনেকেই বলল। তারা অভিযোগ করল যে, রোজ তারা এক বেলা খেতে পায়- এক কি দুই টুকরা রুটি। কোন এক ক্যাম্পের জনৈক স্বেচ্ছাসেবক রিলিফকর্মী জানাল যে, “সরকারী কর্মচারীরা জনসাধারণের কোন তোয়াক্কা করে না। তারা বাইরের জগতে সরকারের মান বজায় রাখতে ব্যস্ত। এ কারণেই তারা লোকদেরকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যাচেছ। বিদেশীরা ভূখা-জনতাকে রাস্তায় দেখুক এটা তারা চায় না।”


১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষের কারণসমূহের উল্লেখযোগ্য কয়েকটিঃ

১) দূর্নীতি-স্বজনপ্রীতিঃ
খাদ্যশস্যের সূষম বন্টনের অভাব এবং দূর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, পার্শ্ববর্তী দেশে চোরাচালানী ইত্যাদি ছিল দূর্ভিক্ষের ‍অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। মূলতঃ শেখ মুজিবুর রহমান কখনই বিশ্বাস করতেন না যে তার অধীনস্থ লোকজন এত অসৎ হবে। তার ধারনা ছিল এইসব লোকেরা দেশকে ভালোবাসে, তাকে ভালোবাসে। তারা তার সাথে কখনও বেঈমানি করবে না। কিন্তু বাস্তব ঘটনা ছিল তার উল্টো। বিভিন্ন চাটুকার আর মিথ্যাবাদীদের দ্বারা তিনি ছিলেন ঘেরা। শুধু তাই নয় এইসব অসৎ তোষামোদকারীদের বিরুদ্ধে কোন নালিশও উনি শুনতেন না বা শুনতে চাইতেন না। শেখ মুজিবুর রহমান একজন বাগ্মীপূরুষ এবং তেজী নেতা হলেও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শাসক হিসেবে ছিলেন খুবই আবেগপ্রবণ। তার এই অদম্য স্নেহতে তার কিছু অনুসারী এবং সরকারী লোকজন বেপরোয়া হয়ে উঠে। ধরাকে সরা জ্ঞান করতে ‍থাকে। যার ফলে সমাজের প্রতিটি রন্ধে রন্ধে দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ছড়িয়ে পড়ে।

বৈদেশিক সাহায্য আসলেও সেটা বিতরণে ছিল যথেষ্ঠ অনিময়। এটা শেখ মুজিবুর রহমান পরে বুঝতে পেরেছিলেন তবে অনেক পরে। তাইতো কোন একসময়ে উনি বলেছিলেন,“সাত কোটি লোকের দেশে আমার ভাগের কম্বলট‍া কই।” যদিও এ কথাটি উনি খুবই দুঃখ করে বলেছিলেন।

১৯৭৪ সালের অক্টোবরে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দুর্ভিক্ষের জন্য প্রকাশ্যে সরকারের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে দুর্ভিক্ষের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে সর্বদলীয় ভিত্তিতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটাই তার জন্য কাল হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। এ সম্পর্কিত একটি চিঠির সঙ্গে পদত্যাগপত্রও পাঠানো হয়েছিল তার কাছে। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর সে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও সেইসময়কার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।


রাস্তার মোড়ে মোড়ে না খেতে পেয়ে মরে যাওয়া আদম সন্তানগুলোকে দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি, তবে কি ওদের মানুষ হয়ে জন্মানোটাই পাপ?


পৃথিবীতে আসতে না আসতেই শিশুটি বুঝেছিল, তার জন্য এ পৃথিবীতে খাদ্য বরাদ্দ নেই। তাই আবার পত্রপাঠ বিদায়, কি দোষ করেছিল এ শিশুটি? কেন তার উপরেও প্রকৃতির নিষ্ঠুর প্রতিশোধ?

২) চোরাচালানঃ
দূর্ভিক্ষের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো চোরাচালান। ১৯৭৪ সালে ২রা অক্টোবর প্রকাশিত লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় জেকুইস লেসলীর কলাম অনুসারেঃ “একজন মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,আর অসহায় দুষ্টিতে তার মরণ-যন্ত্রণাকাতর চর্মসার শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হতে চায় না, তাই কথাটি বোঝাবার জন্য জোর দিয়ে মাথা নেড়ে একজন ইউরোপীয়ান বললেন, সকালে তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন,এমন সময় এক ভিখারি এসে হাজির। কোলে তার মৃত শিশু। বহু বিদেশী পর্যবেক্ষক মনে করেন বর্তমান দুর্ভিক্ষের জন্য বর্তমান সরকারই দায়ী। “দুর্ভিক্ষ বন্যার ফল ততটা নয়,যতটা মজুতদারী চোরাচালানের ফল”-বললেন স্থানীয় একজন অর্থনীতিবিদ।.. প্রতি বছর যে চাউল চোরাচালন হয়ে (ভারতে) যায় তার পরিমাণ ১০ লাখ টন।”

এইসব চোরাচালানকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল ধান, চাল, গম, পাট, যুদ্ধাস্ত্র, ঔষধ, মাছ, গরু, বনজ সম্পদ ইত্যাদি। একটা নবগঠিত স্বাধীন দেশের সম্পদ ভারতে পাচার করা হতো কার স্বার্থে? কারা এসবের মদদদাতা ছিল? জনতার মুখপত্র, ১ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত সংবাদ হিসেবে সেই সময়ে ভারতে পাচার হয়ে যায় প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার পন্য।

মেজর অব: মো: রফিকুল ইসলাম বীরোত্তমের “শাসনের ১৩৩৮ রজনী” পৃ: ১১৯-১২৬ তে উনি লিখেছেন, “দীর্ঘ ৩ টি বছর আমরা এমনটি প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের চোখের সামনে চাল-পাট পাচার হয়ে গেছে সীমান্তের ওপারে, আর বাংলার অসহায় মানুষ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে।”

ক্ষুধার্ত মানুষ নাকি হায়নার চেয়েও হিংস্র। তাই খাদ্যশস্য বোঝাই ট্রাকের উপর প্রহরীর সতর্ক প্রহরা। কিন্তু যারা মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে চোরাচালানী করে দেশে দূর্ভিক্ষ বানিয়েছিল তাদেরকে কে পাহাড়া দিবে?

৩) দাতাগোষ্ঠীর অনমনীয়তা ও অনিচ্ছাঃ
সেইসময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিল সোভিয়েত নৌ কন্টিনজেন্ট। তারা অবশ্য প্রকাশ্যে মাইন সাফ করার পাশাপাশি গোপনে বঙ্গোপসাগরে হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভেও চালিয়েছিল। সোভিয়েতদের আশা ও উদ্দেশ্য ছিল এখানে একটা স্থায়ী ঘাঁটি বানানো। সেইজন্যই অনেকটা পাল্টা চাপ আসছিল আমেরিকানদের তরফ থেকে, সোভিয়েতদের তাড়াও নইলে খাদ্য সাহায্য কমে যাবে।


হাড্ডিসার এ শিশুটিও বুঝে গিয়েছিল রিলিফের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়, তাইতো পাত্র হাতে ঘরের সামনে নালা পেরিয়ে হয়ত ছুটেছে কিছু পাবার আশায়। ভাগ্যে কি ঘটেছিল তার কে জানে?

তবে সব দোষ বিদেশীদের উপরে চাপানো ঠিক নয়। আরো কিছু ব্যাপার ছিল, ৭১-৭২ এ যে বিপুল পরিমান সাহায্য এসেছিল তার বেশিরভাগ লোপাট হয়ে যাওয়াতে আবারো বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাতে প্রবল অনীহা দেখা দেয় দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে। লুটের সিংহভাগ হয়েছে রেডক্রসের মাধ্যমে। ৭৪ সালেই জরুরী অবস্থা চালু হয়। সে যাইহোক অনাহারে হু হু করে মানুষ মরছিল।

৪) বর্ডার ট্রেডঃ
বর্ড‍ার ট্রেডের নামে খুলে দেয়া হয় সীমান্ত। আসলে এই সিস্টেম শুধু চোরাচালানকেই উদ্ভুদ্ধ করা হয়েছে।এর ফলে চোরাচালানীদের যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল, তা আজও আছে এবং তা দেশের অনুন্নত অর্থনীতির জন্য দায়ী।

আবুল মনসুর আহমদের লেখা আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর, ৪৯৮ নং পৃষ্ঠায় উনি লিখেছেন, “সীমান্তের ১০ মাইল এলাকা ট্রেডের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হলো। এর ফলে ভারতের সাথে চোরাচালানের মুক্ত এলাকা গড়ে উঠে। পাচার হয়ে যায় দেশের সম্পদ।”

৫) জালনোটের চালানঃ
ভারত থেকে বিশাল অংকের জাল নোট বাংলাদেশের বাজারে আসতো। এতে অর্থনৈতিক অবক্ষয় আরো তরান্বিত হয়। সরকার ও জনগণও জিম্মি হয়ে পড়ে এই জালনোটের কাছে।

আব্দুর রহিম আজাদের লেখা, ৭১ এর গণহত্যার নায়ক বই এর ৫২ নং পৃষ্ঠা অনুসারে সেই সময়ে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন বলতে বাধ্য হয়েছেন, “জালনোট আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করিয়া দিয়াছে।”

অলি আহাদের লিখা জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫, ৫২৮-৫৩১ নং পৃষ্ঠায় পাট চোরাচালান সর্ম্পকিত একটি লেখায় লিখেছেন, “নাম মাত্রমূল্যে বা জালটাকায় পাট পাচার শুরু হল।”

উপসংহারঃ
এই ভুখন্ডের ৩০০ বছরের নিকটবর্তী ইতিহাসে বড় বড় তিনটি দূর্ভিক্ষ আঘাত হেনেছে। আর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম দূর্ভিক্ষ ১৯৭৪ সালে। সরকারী কিছু লোকজন সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের সুবিধাবাদী লোকজন বাংলাদেশের মানুষদের নিয়ে হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল। সমাজের রন্ধে রন্ধে দূর্নীতি ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর তার সাথে সমানতালে চলেছে ভারতীয় আগ্রাসন। একটা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চলেছিল অর্থনীতি ধ্বংসের। উৎপাদন কমে গিয়েছিল, শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছিল। কলকারখানা ধ্বংস হয়েছিল। গুপ্ত হত্যা শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার চেতনায় বলিয়ান স্বাধীন চেতা মানুষদেরকে ভিক্ষার পাত্র ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল।



abahar.canada

unread,
Sep 25, 2021, 1:31:34 PM9/25/21
to PFC-Friends
BUT in the Awami imagination, still"the Best Bengali of all time!"

zainul abedin

unread,
Sep 26, 2021, 12:37:21 PM9/26/21
to PFC-Friends
Assalamu-Alaikum and thanks for sharing.

Most discussants do not mention the 1974 Great Famine as one the causes of downfall of Mujib's Bakshal regime! Eve, Amartya Sen's findings say that access of the poor to the food was more responsible than the shortage (and/or supply) of food for the famine that caused deaths of about 1.5 million Bangladeshis in 1974-75.


ZA
On Saturday, September 25, 2021, 12:31:37 PM CDT, abahar.canada <abahar...@gmail.com> wrote:


BUT in the Awami imagination, still"the Best Bengali of all time!"

On Thursday, December 31, 2015 at 1:46:45 PM UTC-5 Raza Mia wrote:

দুর্ভিক্ষ ১৯৭৪, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কৃষ্ণকাল


মাছধরার জাল পড়া সেই বাসন্তী পাশে তার বোন দূর্গতী (কলাগাছের কান্ড সংগ্রহ করছে)

“একটি তিন বছরের শিশু এতই শুকনো যে, মনে হল সে যেন মায়ের পেটে থাকাকালীন অবস্থায় ফিরে গেছে। আমি তার হাতটা ধরলাম। মনে হল তার চামড়া আমার আঙ্গুলে মোমের মত লেগে গেছে। এই দুর্ভিক্ষের আর একটি ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান এই যে, বিশ্বস্বাস্থ্ সংস্থার মতে ৫০ লাখ মহিলা আজ নগ্ন দেহ। পরিধেয় বস্ত্র বিক্রি করে তারা চাল কিনে খেয়েছে।”

“সন্ধা ঘনিয়ে আসছে এবং গাড়ী আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম-এর লরীর পিছনে পিছনে চলেছে। এই সমিতি ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ জানালেন,“স্বাভাবিক সময়ে আমরা হয়ত কয়েক জন ভিখারীর মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি। কিন্তু এখন মাসে অন্ততঃ ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি- সবই অনাহার জনিত মৃত্যু।”

উপরের এই প্যারা দুটি প্রখ্যাত তথ্য-অনুসন্ধানী অষ্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক জন পিলজারের লিখা। লেখাটি ছাপা হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ১৭ই ডিসেম্বর লন্ডনের ডেইলী মিরর পত্রিকায়। তার এই কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল ১০ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে যখন কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলাট ডাটিয়া পাড়ার এক জেলেপাড়ার বস্ত্রহীন “বাসন্তি” মাছ ধরার জাল পড়ে লজ্জা ঢাকা ছবি ছাপা হয়েছিল। (যদিও এ ছবিকে একটি সাজানো নাটক বলে মন্তব্য করেন একশ্রেণীর বিশ্লেষক কিন্তু এইঘটনার মত ঘটনা যে ঘটেছে তা তো আর মিথ্যা নয়, এইসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেক খুঁজে পাওয়া যাবে )

মাছধরার জাল পড়া সেই বাসন্তী পাশে তার বোন দূর্গতী (কলাগাছের কান্ড সংগ্রহ করছে)

চালের পয়সা জোগাড় করতে অনেক পিতা-মাতা কোলের সন্তানকেও বিক্রি করে দেবার মত নির্মম নিষ্ঠুর কাজ করেছে। এমনও খবর তখনকার পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যাও করেছে। আজ এত বছর পরে সভ্য সমাজে এসে আমরা হয়ত এগুলো অনুভব করতে পারবো না। কিন্তু বাস্তব চিত্র আরো করুন ছিল।

বাস্তাবিক পক্ষে ঠিক এমনি বা এরচেয়েও খারাপ অবস্থা হয়েছে যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৭৪ এর মার্চ মাসে রংপুর জেলা থেকে শুরু হয় এই দুর্ভিক্ষ। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি চালের দাম মণ প্রতি দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ টাকার মত। অথচ স্বাধীনতার আগে মণপ্রতি চালের দাম ছিল সেইসময়কার দামের তুলনায় দশভাগ কম। এই সময়টাকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেকে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে করুন সময় বলে অভিহিত করে থাকেন। এই দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে হয়ত ঘূর্ণিঝড় আর ব্রহ্মপুত্র থেকে সৃষ্ট বণ্যাকে দায়ী করা হয়। বাস্তবিক পক্ষে এর আরো কারণও ছিল মূলতঃ সেগুলোই আসল। দশ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মারা গেলেও সরকারী হিসেবে মাত্র ২৭ হাজার। দুঃখজনক।

নয়মাস ব্যাপী মুক্তিসংগ্রামে ত্রিশলক্ষ বা তার অধিক লোক মারা গেলেও জানা মতে, না খেয়ে ভাতের অভাবে বোধহয় কেউ মারা যায় নি। অথচ স্বাধীনতার চতুর্থ বছরে এসে একটা স্বাধীন সরকারের অধীনে ভাত না পেয়ে মারা গেছে প্রায় ১০ লক্ষ লোক। এই মৃতের দলে আছে অবশ্য ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ও কলেরায় মৃত্যুবরণকারী অনেকেই। যদিও তাদের মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ ঐ দুর্ভিক্ষ। সূষম খাদ্যের অভাবে মানুষ তখন অখাদ্যও খেয়েছে। এখনও অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বলে থাকেন যে, তারা নিজে চোখে দেখেছেন ডাষ্টবিনে উচ্ছিষ্ট থেকে খাদ্যকুটা খোঁজা মানুষ আর কুকুরের লড়াই। অনেকে এরচেয়েও খারাপ দৃশ্য দেখেছেন, যার বর্ণনা আজ প্রায় ৩৭ বছর পর এসে সুস্থ্য মানুষের পক্ষে শোনাটাই একটা নির্যাতন সরূপ।

১৭৭০ সালের ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে ভারত-ইংরেজ দ্বৈত-শাসনের কুফল আর ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ অর্থাৎ পঞ্চাশের মন্বন্তরের জন্য সম্পূর্ণ বিদেশী শাসক প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে দায়ী করলেও কিন্তু ১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষের জন্য শুধু বিদেশি শক্তিকে আর প্রকৃতিকে দায়ী করা চলে না বরং দায়ী অনেক অংশে দেশের অভ্যন্তরীন দুঃশাসন। মূলতঃ এইসময় থেকেই সরকারের উপর থেকে আওয়ামীলীগের সমর্থকদের তথা দেশবাসীর মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। দীর্ঘদিন পাকি যাতাকলে পিষ্ঠ এবং ৭১ এর রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বজনহারানো এদেশের মানুষের আশা ছিল স্বাধীন দেশে ভালো ভাবে বাঁচার। কিন্তু সরকারদলীয় কিছু লোকেদের সীমাহীন দূর্নীতি, দুঃশাসন এবং কিছু উল্লেখযোগ্য বাহিনীর অতি উৎসাহী তৎপরতায় জনগণের সেই স্বপ্ন অচিরেই হারিয়ে যায়। মানুষ রাজনীতিতে বিতশ্রদ্ধ হয় এবং আস্থা হারিয়ে ফেলে। সময়ের ফলাফলে আসা দূর্ভিক্ষ জনগণের মনোবল আরো নাজুক পরিস্থিতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। বিশ্বাসের দেয়ালে ধরে চিঁড়।

১৯৭৪ সালে ১৮ অক্টোবর বোষ্টনের ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটরে ডানিয়েল সাদারল্যান্ড লিখেছিলেন, “গত দুই মাসে যে ক্ষুধার্ত জনতা স্রোতের মত ঢাকায় প্রবেশ করেছে,তাদের মধ্যে সরকারের সমর্থক একজনও নেই। বন্যা আর খাদ্যাভাবের জন্য গ্রামাঞ্চল ছেড়ে এরা ক্রমেই রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে সরকার এদেরকে রাজপথের ত্রিসীমানার মধ্যে ঢুকতে না দিতে বদ্ধপরিকর। এরই মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যককে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে সারাদিন দুই এক টুকরা রুটি খেতে পাওয়া যায, মাঝে মাঝে দুই-একটা পিঁয়াজ ও একটু-আধটু দুধ মেলে। ক্যাম্পে ঢুকলে আর বের হওয়া যায় না। “যে দেশে মানুষকে এমন খাঁচাবদ্ধ করে রাখা হয় সেটা কি ধরনের স্বাধীন দেশ”- ক্রোধের সাথে বলল ক্যাম্পবাসীদেরই একজন। ক্যাম্পের ব্লাকবোর্ডে খড়িমাটি দিয়ে জনৈক কর্মকর্তা আমার সুবিধার্থে প্রত্যেকের রুটি খাওয়ার সময়সূচীর তালিকা লিখে রেখেছেন। “তালিকায় বিশ্বাস করবেন না”-ক্যাম্পের অনেকেই বলল। তারা অভিযোগ করল যে, রোজ তারা এক বেলা খেতে পায়- এক কি দুই টুকরা রুটি। কোন এক ক্যাম্পের জনৈক স্বেচ্ছাসেবক রিলিফকর্মী জানাল যে, “সরকারী কর্মচারীরা জনসাধারণের কোন তোয়াক্কা করে না। তারা বাইরের জগতে সরকারের মান বজায় রাখতে ব্যস্ত। এ কারণেই তারা লোকদেরকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যাচেছ। বিদেশীরা ভূখা-জনতাকে রাস্তায় দেখুক এটা তারা চায় না।”


১৯৭৪ সালের দূর্ভিক্ষের কারণসমূহের উল্লেখযোগ্য কয়েকটিঃ

১) দূর্নীতি-স্বজনপ্রীতিঃ
খাদ্যশস্যের সূষম বন্টনের অভাব এবং দূর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, পার্শ্ববর্তী দেশে চোরাচালানী ইত্যাদি ছিল দূর্ভিক্ষের ‍অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। মূলতঃ শেখ মুজিবুর রহমান কখনই বিশ্বাস করতেন না যে তার অধীনস্থ লোকজন এত অসৎ হবে। তার ধারনা ছিল এইসব লোকেরা দেশকে ভালোবাসে, তাকে ভালোবাসে। তারা তার সাথে কখনও বেঈমানি করবে না। কিন্তু বাস্তব ঘটনা ছিল তার উল্টো। বিভিন্ন চাটুকার আর মিথ্যাবাদীদের দ্বারা তিনি ছিলেন ঘেরা। শুধু তাই নয় এইসব অসৎ তোষামোদকারীদের বিরুদ্ধে কোন নালিশও উনি শুনতেন না বা শুনতে চাইতেন না। শেখ মুজিবুর রহমান একজন বাগ্মীপূরুষ এবং তেজী নেতা হলেও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শাসক হিসেবে ছিলেন খুবই আবেগপ্রবণ। তার এই অদম্য স্নেহতে তার কিছু অনুসারী এবং সরকারী লোকজন বেপরোয়া হয়ে উঠে। ধরাকে সরা জ্ঞান করতে ‍থাকে। যার ফলে সমাজের প্রতিটি রন্ধে রন্ধে দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ছড়িয়ে পড়ে।

বৈদেশিক সাহায্য আসলেও সেটা বিতরণে ছিল যথেষ্ঠ অনিময়। এটা শেখ মুজিবুর রহমান পরে বুঝতে পেরেছিলেন তবে অনেক পরে। তাইতো কোন একসময়ে উনি বলেছিলেন,“সাত কোটি লোকের দেশে আমার ভাগের কম্বলট‍া কই।” যদিও এ কথাটি উনি খুবই দুঃখ করে বলেছিলেন।

১৯৭৪ সালের অক্টোবরে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দুর্ভিক্ষের জন্য প্রকাশ্যে সরকারের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি সেই সঙ্গে দুর্ভিক্ষের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে সর্বদলীয় ভিত্তিতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটাই তার জন্য কাল হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। এ সম্পর্কিত একটি চিঠির সঙ্গে পদত্যাগপত্রও পাঠানো হয়েছিল তার কাছে। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর সে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও সেইসময়কার অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।


রাস্তার মোড়ে মোড়ে না খেতে পেয়ে মরে যাওয়া আদম সন্তানগুলোকে দাফনের জন্য নিয়ে যাচ্ছে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের গাড়ি, তবে কি ওদের মানুষ হয়ে জন্মানোটাই পাপ?


পৃথিবীতে আসতে না আসতেই শিশুটি বুঝেছিল, তার জন্য এ পৃথিবীতে খাদ্য বরাদ্দ নেই। তাই আবার পত্রপাঠ বিদায়, কি দোষ করেছিল এ শিশুটি? কেন তার উপরেও প্রকৃতির নিষ্ঠুর প্রতিশোধ?

২) চোরাচালানঃ
দূর্ভিক্ষের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো চোরাচালান। ১৯৭৪ সালে ২রা অক্টোবর প্রকাশিত লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় জেকুইস লেসলীর কলাম অনুসারেঃ “একজন মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে,আর অসহায় দুষ্টিতে তার মরণ-যন্ত্রণাকাতর চর্মসার শিশুটির দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হতে চায় না, তাই কথাটি বোঝাবার জন্য জোর দিয়ে মাথা নেড়ে একজন ইউরোপীয়ান বললেন, সকালে তিনি অফিসে যাচ্ছিলেন,এমন সময় এক ভিখারি এসে হাজির। কোলে তার মৃত শিশু। বহু বিদেশী পর্যবেক্ষক মনে করেন বর্তমান দুর্ভিক্ষের জন্য বর্তমান সরকারই দায়ী। “দুর্ভিক্ষ বন্যার ফল ততটা নয়,যতটা মজুতদারী চোরাচালানের ফল”-বললেন স্থানীয় একজন অর্থনীতিবিদ।.. প্রতি বছর যে চাউল চোরাচালন হয়ে (ভারতে) যায় তার পরিমাণ ১০ লাখ টন।”

এইসব চোরাচালানকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল ধান, চাল, গম, পাট, যুদ্ধাস্ত্র, ঔষধ, মাছ, গরু, বনজ সম্পদ ইত্যাদি। একটা নবগঠিত স্বাধীন দেশের সম্পদ ভারতে পাচার করা হতো কার স্বার্থে? কারা এসবের মদদদাতা ছিল? জনতার মুখপত্র, ১ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত সংবাদ হিসেবে সেই সময়ে ভারতে পাচার হয়ে যায় প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার পন্য।

মেজর অব: মো: রফিকুল ইসলাম বীরোত্তমের “শাসনের ১৩৩৮ রজনী” পৃ: ১১৯-১২৬ তে উনি লিখেছেন, “দীর্ঘ ৩ টি বছর আমরা এমনটি প্রত্যক্ষ করেছি। আমাদের চোখের সামনে চাল-পাট পাচার হয়ে গেছে সীমান্তের ওপারে, আর বাংলার অসহায় মানুষ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে।”

ক্ষুধার্ত মানুষ নাকি হায়নার চেয়েও হিংস্র। তাই খাদ্যশস্য বোঝাই ট্রাকের উপর প্রহরীর সতর্ক প্রহরা। কিন্তু যারা মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে চোরাচালানী করে দেশে দূর্ভিক্ষ বানিয়েছিল তাদেরকে কে পাহাড়া দিবে?

৩) দাতাগোষ্ঠীর অনমনীয়তা ও অনিচ্ছাঃ
সেইসময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিল সোভিয়েত নৌ কন্টিনজেন্ট। তারা অবশ্য প্রকাশ্যে মাইন সাফ করার পাশাপাশি গোপনে বঙ্গোপসাগরে হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভেও চালিয়েছিল। সোভিয়েতদের আশা ও উদ্দেশ্য ছিল এখানে একটা স্থায়ী ঘাঁটি বানানো। সেইজন্যই অনেকটা পাল্টা চাপ আসছিল আমেরিকানদের তরফ থেকে, সোভিয়েতদের তাড়াও নইলে খাদ্য সাহায্য কমে যাবে।


হাড্ডিসার এ শিশুটিও বুঝে গিয়েছিল রিলিফের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়, তাইতো পাত্র হাতে ঘরের সামনে নালা পেরিয়ে হয়ত ছুটেছে কিছু পাবার আশায়। ভাগ্যে কি ঘটেছিল তার কে জানে?

তবে সব দোষ বিদেশীদের উপরে চাপানো ঠিক নয়। আরো কিছু ব্যাপার ছিল, ৭১-৭২ এ যে বিপুল পরিমান সাহায্য এসেছিল তার বেশিরভাগ লোপাট হয়ে যাওয়াতে আবারো বাংলাদেশে সাহায্য পাঠাতে প্রবল অনীহা দেখা দেয় দাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে। লুটের সিংহভাগ হয়েছে রেডক্রসের মাধ্যমে। ৭৪ সালেই জরুরী অবস্থা চালু হয়। সে যাইহোক অনাহারে হু হু করে মানুষ মরছিল।

৪) বর্ডার ট্রেডঃ
বর্ড‍ার ট্রেডের নামে খুলে দেয়া হয় সীমান্ত। আসলে এই সিস্টেম শুধু চোরাচালানকেই উদ্ভুদ্ধ করা হয়েছে।এর ফলে চোরাচালানীদের যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল, তা আজও আছে এবং তা দেশের অনুন্নত অর্থনীতির জন্য দায়ী।

আবুল মনসুর আহমদের লেখা আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর, ৪৯৮ নং পৃষ্ঠায় উনি লিখেছেন, “সীমান্তের ১০ মাইল এলাকা ট্রেডের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হলো। এর ফলে ভারতের সাথে চোরাচালানের মুক্ত এলাকা গড়ে উঠে। পাচার হয়ে যায় দেশের সম্পদ।”

৫) জালনোটের চালানঃ
ভারত থেকে বিশাল অংকের জাল নোট বাংলাদেশের বাজারে আসতো। এতে অর্থনৈতিক অবক্ষয় আরো তরান্বিত হয়। সরকার ও জনগণও জিম্মি হয়ে পড়ে এই জালনোটের কাছে।

আব্দুর রহিম আজাদের লেখা, ৭১ এর গণহত্যার নায়ক বই এর ৫২ নং পৃষ্ঠা অনুসারে সেই সময়ে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন বলতে বাধ্য হয়েছেন, “জালনোট আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করিয়া দিয়াছে।”

অলি আহাদের লিখা জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫, ৫২৮-৫৩১ নং পৃষ্ঠায় পাট চোরাচালান সর্ম্পকিত একটি লেখায় লিখেছেন, “নাম মাত্রমূল্যে বা জালটাকায় পাট পাচার শুরু হল।”

উপসংহারঃ
এই ভুখন্ডের ৩০০ বছরের নিকটবর্তী ইতিহাসে বড় বড় তিনটি দূর্ভিক্ষ আঘাত হেনেছে। আর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম দূর্ভিক্ষ ১৯৭৪ সালে। সরকারী কিছু লোকজন সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের সুবিধাবাদী লোকজন বাংলাদেশের মানুষদের নিয়ে হোলিখেলায় মেতে উঠেছিল। সমাজের রন্ধে রন্ধে দূর্নীতি ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর তার সাথে সমানতালে চলেছে ভারতীয় আগ্রাসন। একটা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চলেছিল অর্থনীতি ধ্বংসের। উৎপাদন কমে গিয়েছিল, শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছিল। কলকারখানা ধ্বংস হয়েছিল। গুপ্ত হত্যা শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার চেতনায় বলিয়ান স্বাধীন চেতা মানুষদেরকে ভিক্ষার পাত্র ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল।



--
You received this message because you are subscribed to the Google Groups "PFC-Friends" group.
To unsubscribe from this group and stop receiving emails from it, send an email to pfc-friends...@googlegroups.com.
To view this discussion on the web visit https://groups.google.com/d/msgid/pfc-friends/24e401f2-4a06-48bf-a3fb-920cef8530f2n%40googlegroups.com.
Reply all
Reply to author
Forward
0 new messages