বাংলাদেশে বয়ানের যুদ্ধ, একাত্তরের চেতনার নাশকতা এবং বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতার সুরক্ষা
ফিরোজ মাহবুব কামাল
www.drfirozmahboobkamal.com/blog/বাংলাদেশে-বয়ানের-যুদ্ধ-এ-2/
হাসিনা পালালেও তার বয়ান বেঁচে আছে
২০২৪’য়ের ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সাংস্কৃতিক ও মিডিয়ার অঙ্গণে এখনো বেঁচে আছে তার বয়ান। সে বয়ান ধারণ করে শুধু হাসিনার অনুসারী আওয়ামী ঘরনার রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও বুদ্ধিজীবীগণই নয়, বরং বিএনপি ও এনসিপিসহ বহু রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীও। সে বিশেষ বয়ানটি হলো একাত্তরে বাংলাদেশের জন্ম ও ভারতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে। রাজনীতি হলো বস্তুত বিশেষ এক বয়ানকে বিজয়ী করার লড়াই। তাই বয়ান না থাকলে রাজনীতি থাকে না। রাজনীতির সে বয়ান যেমন ইসলামী হতে পারে, তেমনি হতে পারে জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, ফ্যাসিবাদী, হিন্দুত্ববাদী, সাম্যবাদী বা নাস্তিক্যবাদী। তাই কোন দলের রাজনীতিকে পরাজিত করতে হলে সে রাজনীতির বয়ানকে দাফন করতে হয়। এজন্যই প্রতিটি রাজনৈতিক যুদ্ধই হলো বয়ানের যুদ্ধ।
একাত্তরের বয়ানের মূল কথা হলো, বাংলাদেশের প্রকৃত জনক হলো ভারত। ফলে এ বয়ানের ধারকগণ বাংলাদেশীদের ভারতের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ ও অনুগত থাকতে বলে। তারা বলে, ভারতের ঋণ কখনো শোধ দেয়া যাবে না। ভারত ও ভারতসেবীদের সে দাবীর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। কারণ, ভারতীয় সেনা বাহিনীর যুদ্ধে নামার পূর্বে প্রায় সাড়ে ৮ মাসে মুক্তিবাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোন জেলা বা কোন মহাকুমা দূরে থাক, একটি থানাও স্বাধীন করতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল ১০ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে গঠিত বিশাল ভারতীয় সেনা বাহিনী। তখন পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মাত্র ৩ ডিভিশন পাকিস্তানী সৈন্য। প্রতি ডিভিশনে থাকে প্রায় ১৫ হাজার সৈন্য; ফলে সেদিন ৪৫ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যের বিপরীতে যুদ্ধ করেছিল ১৫০ হাজার ভারতীয় সৈন্য। এ যুদ্ধে তিন হাজারের বেশী ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছিল। তাই একাত্তরের যুদ্ধে ভারতের অর্থ ও রক্তের বিনিয়োগটি ছিল বিশাল। ফলে একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী হলে ভারতকে বাংলাদেশের জনক বা পিতা না বলে উপায় নেই। এবং যতদিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে ততদিন বাংলাদেশীদের ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অধীনতা নিয়ে বাঁচতেই হবে -যেমনটি বেঁচেছিল শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও তাদের অনুসারীগণ। ভারত বিরোধী হলে, ভারত তাকে নিমক হারাম বলে গালি দিবে -সেটিই স্বাভাবিক। ২০২৪’য়ের আগস্ট হাসিনার বিতাড়নের পর থেকে ভারতীয় মিডিয়া লাগাতর সে গালিই শুনিয়ে আসছে। কারণ হাসিনা ছিল ভারতের প্রতি আনুগত্যের প্রতীক।
রাজনৈতিক বিপ্লবের আগে চেতনা রাজ্য বিপ্লব চাই
যে কোন বিপ্লবের শুরু চেতনায় ভূবনে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। বিজয়ী করতে হয় নতুন বয়ানকে। যে ভাবনা নিয়ে মানুষ বাঁচে, স্বপ্ন দেখে এবং রাজনীতির লড়াই করে -সেটিই হলো তার বয়ান। সে বয়ান জন্ম নেয় দর্শন-সমৃদ্ধ বিশেষ তাড়না থেকে। চেতনা হলো একটি বিশ্বাস বা দর্শনের জাগ্রত রূপ -যা ব্যক্তিকে তাড়িত করে বিশেষ এক রাজনৈতিক বিপ্লবের দিকে। দেশের জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস, শিক্ষা-সংস্কৃতি, কর্ম, আচরণ, রাজনীতি ও স্বাধীনতার অঙ্গণে বিপ্লব আনতে হলে সর্ব প্রথম জনগণের চেতনার ভুবনে বিপ্লব আনতে হয়। প্রতিটি ধর্মীয়, নৈতিক, চারিত্রিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শুরুটি হয় এই চেতনার বিপ্লব থেকেই। তাই জনগণের চেতনা পাল্টাতে সফল না হলে সে দেশের ধর্মীয, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় পাল্টানো যায় না। পবিত্র কুরআনে সুরা ইসরা'র ৮৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া তায়ালা বলেছেন,
قُلْ كُلٌّۭ يَعْمَلُ عَلَىٰ شَاكِلَتِهِۦ فَرَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَنْ هُوَ أَهْدَىٰ سَبِيلًۭا
অর্থ: " (হে রাসুল) বলুন এবং অন্যদের জানিয়ে দিন, প্রতিটি মানুষ আমল করে তার চেতনার ধরণ বা মডেল অনুযায়ী, এবং আপনার প্রতিপালক জানেন জীবনের পথ চলায় কে সত্য পথ প্রাপ্ত।"
উপরিউক্ত আয়াতে সর্বজ্ঞানী মহান রব বুঝিয়েছেন, ব্যক্তির ধর্ম-কর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও জীবনযাত্রা কোন ধারায় প্রবাহিত হবে -সেটি নির্ধারিত হয় দর্শন তথা চেতনার মডেল থেকে। তাই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গণে বিপ্লব আনতে হলে শুরু করতে হয় মগজে বাসা বাধা চেতনার মডেল পাল্টানোর মধ্য দিয়ে। এ আয়াতের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা নবীজী (সা:)কে তাগিদ দিয়েছেন, পৌত্তলিক কাফেরদের মুসলিম করতে হলে বিপ্লব আনতে হবে তাদের চেতনার ভুবনে। শুরুর এ কাজটি শুরুতে না হলে বিপ্লব শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। আল্লাহ তায়ালা চান ঈমানদারগণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ যুদ্ধে বিজয়ী হোক। তাই তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন এ যুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র; সেটি হলো পবিত্র কুর’আন। এ কুর’আনী জ্ঞানের অস্ত্র নিয়েই নবীজী (সা:) মুসলিম জীবনে বিপ্লব এনেছেন। ইসলামে এটিই হলো বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ তথা war of narratives। পবিত্র কুরআনে সূরা ফুরকানের ৫২ নাম্বার আয়াতে এ যুদ্ধকে জিহাদান কবিরা তথা বড় যুদ্ধ বলা হয়েছে। বলা হয়েছে:
فَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَجَـٰهِدْهُم بِهِۦ جِهَادًۭا كَبِيرًۭا
অর্থ: “অতঃপর আপনি কাফিরদের (ধর্ম, দর্শন, মতবাদ, বয়ান, সংস্কৃতি) অনুসরণ করবেন না, বরং এই কুর’আন দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বড় জিহাদটি লড়ুন।”
বাংলাদেশের সকল ব্যর্থতার মূল রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে তাদের নিদারুন ব্যর্থতা। কারণ, বয়ানের এ যুদ্ধে তারা নিরস্ত্র। তাদের হাতে নাই কুর’আনী জ্ঞানের অস্ত্র। তারা পবিত্র কুর’আন তেলাওয়াত করে বটে, কিন্তু বুঝার চেষ্টা করেনা। ফলে বার বার রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও সংঘটিত হচ্ছে না কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব । অপরিবর্তিত থেকে যাচ্ছে তাদের চেতনার মানচিত্র। একই কাণ্ড ঘটেছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে। চেতনার মানচিত্রকে একাত্তরের ভারতসেবী সেকুলার ও জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারনায় অধিকৃত রেখে দেশের রাজনীতিতে কখনোই ইসলামী চেতনা, গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা দেয়া যায় না। দূষিত চেতনা তখন কাজ করে দুর্বৃত্তির প্লাবন, ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় অধিকৃতি প্রতিষ্ঠা দেয়ার হাতিয়ার রূপে। বাংলাদেশের বিগত ৫৪ বছরের শাসন আমলে সেটিই প্রমাণিত হয়েছে। তাই বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে একাত্তরের মিথ্যা বয়ানকে অবশ্যই দাফন করতে হবে। অথচ এখানেই বাংলাদেশীদের বিশাল ব্যর্থতা।
সমাজতাত্ত্বিক বিচারে ২০২৪’য়ে হাসিনার পতনটি ছিল রাজনৈতিক পট পরিবর্তন; এটি আদৌ কোন বিপ্লব ছিল না। যেমন বিপ্লব ছিল না ১৯৭৫’য়ে মুজিবের এবং ১৯৯১’য়ে এরশাদের উৎখাত। বিপ্লব রূপে গণ্য হতে হলে শুধু সরকার পরিবর্তন হলে চলে না, বিপ্লবটি বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে হতে হয়। পাল্টিয়ে দিতে জনগণের চিন্তা-চেতনার মডেল। ২০২৪’য়ের জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক যুদ্ধের শুরুটি হয়েছিল ছাত্রদের কোটাবিরোধী সুবিধা আদায়ের লড়াই দিয়ে। এ আন্দোলন কখনোই ফ্যাসিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ দিয়ে শুরু হয়নি। হাসিনার পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্ধারিত কোটার বিলুপ্তির ঘোষণা দিলে ছাত্রদের এ কোটা বিরোধী আন্দোলনের বিলুপ্তি ঘটতো। হাসিনা তার রাজনীতিতে এখানেই সবচেয়ে বড় ভুলটি করেছে। হয়তো সে ভুল নিয়ে এখন সে প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগছে।
২০২৪’য়ের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বড় ব্যর্থতা হলো, হাসিনার পতন ঘটালেও একাত্তরের বয়ান বিলুপ্ত করতে পারিনি। সেটি এ আন্দোলেনর লক্ষ্যও ছিল না। ফলে হাসিনার একাত্তরের বয়ান এখনো বেঁচে আছে বিএনপি ও এনসিপিরও নেতাদের মুখে। একাত্তরের যে চেতনা শেখ হাসিনা দেশের ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে, সেটি এখন একই ভাষায় ধ্বনিত হচ্ছে বিএনপি ও এনসিপিরও নেতাদের বয়ানে।
যে বয়ান প্রতিষ্ঠিত শত ভাগ মিথ্যার উপর
একাত্তরের বয়ানটি শত ভাগ মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ বয়ান ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস বলে। অথচ সেটি বিশ্বাস করলে ১৯৪৭’য়ের ১৪ই আগস্ট থেকে ১৯৭১’য়ের ২৬ শে মার্চ অবধি এ ২৪ বছরের পাকিস্তানী মেয়াদকালকে পূর্ব পাকিস্তানীদের জন্য পরাধীনতার যুগ রূপে বিশ্বাস করতে হয়। তখন পাকিস্তানকে একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের কলোনী বলতে হয়। অথচ সেটি তো প্রকাণ্ড মিথ্যা। প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কি সেই ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন? শেখ মুজিবও প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন। তাদের কেউই একাত্তরের আগের পাকিস্তানকে কখনো ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বলেননি। অথচ পাকিস্তানকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং সে রাষ্ট্রের বসবাসকারী পূর্ব পাকিস্তানকে পরাধীন না বললে একাত্তরের ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস বলা যায় না। এরূপ প্রকাণ্ড মিথ্যার অবতারণা করা হয়েছে স্রেফ রাজনৈতিক প্রয়োজনে।
একাত্তরে বাংলাদেশের সৃষ্টিকে বড় জোর পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা বলা যেতে পারে। সেটিকে কখনোই স্বাধীনতা বলা যায় না। আর শুধু পাকিস্তান নয়, যে কোন মুসলিম দেশ ভাঙ্গা এবং সে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটি শরিয়তি আইনে হারাম। কারণ সেটি মহান আল্লাহতালা হুকুমের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বিদ্রোহ। একটি দেশ দুর্বৃত্তদের দ্বারা অধিকৃত হতেই পারে। জুলুম, হত্যা ও গণহত্যা থাকতেই পারে। সেগুলি উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া আমলেও হয়েছে। কিন্তু সেগুলি মুসলিম দেশ ভাঙাকে জায়েজ করেনা। তাই কোন মুফতি কখনোই খেলাফত ভাঙাকে জায়েজ করেননি। আল্লাহ তায়ালার জুলুম ও দুর্বৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদকে ফরজ করেছেন। এবং দেশ ভাঙাকের হারাম করেছেন। ঘরে চোর-ডাকাত, হিংস্র পশু বা সাপ ঢুকলে সেগুলি তাড়াতে হয়; অপরাধ হলো সে জন্য গৃহে আগুন দেয়া। এ বিষয়টি জানতেন বলেই কোন ইসলামী দল, কোন মুফতি, কোন আলিম এবং কোন পীর সাহেব একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙ্গাকে কখনো জায়েজ বলেননি, বরং হারাম বলেছেন। আর কোন হারাম যুদ্ধকে কখনোই কোন মুসলিম জনগোষ্ঠির স্বাধীনতা যুদ্ধ বলা যায় না। অথচ সে হারাম নিয়েও একাত্তরের চেতনাধারীদের উৎসব। এ উৎসবে শয়তান ও তার খলিফাগণ খুশি হতে পারে। কিন্তু মহান আল্লাহও কি খুশি হতে পারেন? সে যুদ্ধ ছিল ভারত ও ভারতসেবীদের আয়োজিত শতভাগ ফিতনা। অথচ ফিতনাকে আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ২১৭ নম্বর আয়াতে মানব হত্যার চেয়েও জঘন্যতর বলেছেন। নিউমোনিয়া বা টাইফয়েডে যখন প্রচণ্ড জ্বর উঠে তখন রোগী নিজ গৃহে শুয়েও বাড়ি যাবো, বাড়ি যাবো বলে চিৎকার করে। সেটির কারণ, জ্বরের প্রকোপে মস্তিস্ক বিকৃতি বা বিকাগ্রস্ততা।
শুধু জ্বর নয়, উগ্র স্বার্থপরতা, প্রচণ্ড নাশকতার নেশা এবং দূষিত রাজনৈতিক দর্শনও মানব মনের স্বাভাবিক সুস্থতা বিনষ্ট করেতে পারে। ১৯৭১’য়ে তেমনি এক বিকারগ্রস্ততা ভর করেছিল আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্টদের মনে। তারা তখন আত্মঘাতী, খুনি, ধর্ষক তথা ভয়ানক অপরাধীতে পরিণত হয়েছিল। ফ্যাসিস্ট মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন বহু লক্ষ অপরাধীর জন্ম দিয়েছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তান পরিণত হয় আওয়ামী ফ্যাসিবাদী অপরাধীদের অভয় অরণ্যে। আওয়ামী অপরাধীদের যে চরিত্র হাসিনার আমলে দেখা গেছে, সে অভিন্ন অপরাধী চরিত্র দেখা গেছে ১৯৭১’য়েও। ১৯৭১’য়ের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর এ্যাকশন শুরুর আগেই বহু হাজার বিহারীকে তারা হত্যা করেছে এবং হাজার হাজার বিহারী নারীকে ধর্ষণ করেছে। এরা একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙেছে বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা বা গণতন্ত্র উপহার দিতে নয়, বরং বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে দুর্বল করার ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। পাকিস্তান ভাঙার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ যা পেয়েছে তা হলো বাকশালী ফ্যাসিবাদ এবং গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার কবর। সে সাথে ১৯৭৪’য়ে পেয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ -যাতে প্রায় ১৫ লক্ষ বাংলাদেশীর অনাহারে মৃত্যু ঘটে। হাসিনার আমলে সংঘটিত হয়েছে গণহত্যা, গুম, আয়না ঘর ও বিচার বহির্ভুত হত্যার নৃশংসতা। বাঙালি মুসলিমের হাজার বছরের ইতিহাসে এমন গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধ আর কোন কালেই ঘটেনি।
যুদ্ধটি ছিল শতভাগ ভারতীয় যুদ্ধ
একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল শতভাগ ভারতীয় যুদ্ধ। সেটি ছিল পাকিস্তান ভাঙার ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারতের অর্থে, ভারতের প্রশিক্ষণে, ভারতের অস্ত্রে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা পরিচালিত একটি সম্পূর্ণ ভারতীয় যুদ্ধ। এটি কখনোই বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল না। ১৯৭১’য়ের যুদ্ধ নিয়ে এটিই হলো প্রকৃত সত্য বয়ান। অথচ মিথ্যা দিয়ে সে নিরেট সত্যকে দাফন করা হয়েছে। একাত্তরে চেতনার মূল কথা হলো, ভারতের নিজস্ব এ যুদ্ধকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ বলা। সেটি হলো মূলত হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়দের বন্ধু রূপে গ্রহণ করার বয়ান। অথচ হিন্দুদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করা মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে চিরকালের জন্য হারাম করেছেন। সূরা আল ইমরানের ২৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
لَّا يَتَّخِذِ ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلْكَـٰفِرِينَ أَوْلِيَآءَ مِن دُونِ ٱلْمُؤْمِنِينَ ۖ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَلَيْسَ مِنَ ٱللَّهِ فِى شَىْءٍ
অর্থ: “যারা ঈমানদার তারা মুমিনদের বাদ দিয়ে কাফেরদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করে না; এবং যারা সেরূপ করবে অর্থাৎ তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, আল্লাহ থেকে তাদের আর কিছুই পাওয়ার নেই।”
সূরা মুমতাহানার প্রথম আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে,
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوا۟ عَدُوِّى وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَآءَ
অর্থ: “হে ঈমানদারগণ তোমরা কখনোই আমার শত্রু এবং তোমাদের শত্রুকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না।”।
পৌত্তলিক হিন্দুত্ববাদী কাফেরগণ হলো আল্লাহর শত্রু; তারা শত্রু ইসলাম ও মুসলিমদেরও। পবিত্র কুর’আন সে বয়ান বার বার এসেছে। অথচ একাত্তরের চেতনাধারীরা মুক্তিযুদ্ধের নামে চিহ্নিত শত্রুদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করার হারাম কাজটিই প্রকট ভাবে করেছে এবং সে হারাম কর্মটি তারা অবিরাম অব্যাহত রাখতে চায়। প্রশ্ন হলো, যারা কাফিরদের বন্ধু হয়, তারা কি কখনো মুসলিমদের বন্ধু হতে পারে? শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা ও তাদের অনুসারীরা যেমন স্বাধীন পাকিস্তানের বন্ধু হতে পারিনি, তেমনি বন্ধু হতে পারিনি বাঙালি মুসলিমদেরও। তারা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ভারতের অধিকৃত এক আশ্রিত রাষ্ট্রে। যতদিন একাত্তরের এই ভারতসেবী চেতনা বেঁচে থাকবে, ততদিন বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংকটও।
দেশের স্বাধীনতা বাঁচাতে হলে প্রতিটি মুসলিমের ঈমানী দায় হলো, প্রতি দিন বাঁচতে হবে যুদ্ধ নিয়ে। সেটি যেমন রাজনীতির অঙ্গণে, তেমনি বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে। কারণ ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে শয়তানের যুদ্ধটি বিরামহীন। ফলে মুসলিমদের প্রতিরোধের যুদ্ধটিও বিরামহীন হতে হয়। এ যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় থাকলে বা পরাজিত হলে স্বাধীনতা বাঁচানোর যুদ্ধে সৈনিক জুটবে না। বাংলাদেশের বুকে যতদিন বেঁচে থাকে একাত্তরের ভারতসেবী চেতনা, ততদিন এ বঙ্গীয় মুসলিম ভূমিতে মুজিব-হাসিনার ন্যায় ভারতসেবী দাস সৈনিকই বিপুল সংখ্যায় উৎপাদিত হতে থাকবে। আর তাতে বাঙালি মুসলিমের পরাধীনতাই শুধু বাড়বে। তাই যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঁচাতে চায় তাদের কাছে বিষয়টি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। পবিত্র ইবাদতে পরিণত করতে হবে প্রতিরক্ষার এ ভাবনা ও লড়াইকে -যেমনটি ছিল মুসলিম উম্মাহর গৌরব কালে। ০৮/১২/২০২৫