নবীজী (সা:)’র ইসলাম এবং আজকের ইসলাম
ফিরোজ মাহবুব কামাল
www.drfirozmahboobkamal.com/blog/নবীজী-সার-ইসলাম-এবং-আজকে/
নবীজী (সা:)’র শুরুটি জিহাদ দিয়ে
নবীজী (সা:)’র ইসলাম এবং আজকের ইসলামের মাঝে পার্থক্যটি বিশাল। নবীজী (সা:)’র ইসলাম মুসলিম উম্মাহর বিজয় ও ইজ্জত দিয়েছিল, মুসলিমদের বিশ্বশক্তিতে পরিণত করেছিল। অথচ আজকের ইসলাম পরাজয় ও পরাধীনতা দিয়েছে। দোষ এখানে কুর’আনী ইসলামের নয়। বরং দোষ সে বিকৃত ইসলামের -যা নিয়ে আজকে মুসলিমগণ বসবাস করে। নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের বিজয়ের মূল কারণ, তারা জীবনের মিশনটি বুঝেছিল এবং তাদের জীবনের যাত্রাটি শুরু হয়েছিল সবচেয়ে বড় জিহাদটি দিয়ে। সে জিহাদটি ছিল জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ। সে জিহাদের মোক্ষম অস্ত্র রূপে মহান আল্লাহ তায়ালা নবীজী (সা:)’র হাতে তুলে দেন পবিত্র কুর’আন। কুর’আন হলো পরিশুদ্ধ মানব ও রাষ্ট্র নির্মাণের স্রষ্টার দেয়া টেক্সটবুক। কুর’আন নাযিলের সাথে সাথে প্রথম দিন থেকেই প্রতিটি নর ও নারীর উপর ফরজ করা হয় পবিত্র কুর’আন থেকে শিক্ষালাভ ও জ্ঞানদানকে। অথচ ৫ ওয়াক্ত নামাজ ও মাহে রমযানের এক মাস রোজা ফরজ করা হয়েছে নবীজী (সা:)’র নবুয়ত প্রাপ্তির ১১ বছরের বেশী কাল পর।
এর অর্থ, আরব মুসলিমদের যাত্রা শুরু হয় জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে জিহাদ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ নেক আমল দিয়ে। ফলে নামাজী হওয়ার বহু আগেই তারা সার্বক্ষণিক মুজাহিদে পরিণত হয়েছিল। তাদের জিহাদ ছিল নিজেকে সত্যিকার মু’মিন রূপে গড়ে তোলার। সে সাথে তাদের জীবনে আরেকটি জিহাদ ছিল পরিশুদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের। কারণ সেরূপ সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মিত না হলে অসম্ভব হয় নিজের ও নিজ পরিবারের সদস্যদের পরিশুদ্ধি বাঁচিয়ে রাখা। বৃক্ষও তার বেড়ে উঠার জন্য সহায়ক পরিবেশ চায়; তেমনি সহায়ক পরিবেশ চায় ঈমানদারগণ। তাই ঈমানদারের জীবনে অনিবার্য জিহাদ থাকে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মাণের। এখানেই নবীজী (সা:)’র ইসলামের সাথে আজকের মুসলিমদের বড় পার্থক্য। আজকের মুসলিমগণ না নিজ জীবনের পরিশুদ্ধির জিহাদ নিয়ে বাঁচে, না বাঁচে রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধির জিহাদ নিয়ে। নিজের পরিশুদ্ধির জিহাদ থাকলে তো সে জিহাদের টেক্সটবুক কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনে মনযোগী হতো। আর রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধিতে আগ্রহী হলে তাদের জীবনে ইসলামে রাষ্ট্র নির্মাণের জিহাদে দেখা যেত। আর যারা নিজেকে জান্নাতের যোগ্য রূপে গড়ে তোলার জিহাদে লিপ্ত হয়, তারা শক্তি, সাহস ও প্রশিক্ষণ পায় অবিরাম রাজনৈতিক ও সশস্ত্র জিহাদের। সে জিহাদের বরকতেই নবীজী (সা:)’র যুগে ইসলামী রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছিল এবং মুসলিমগণ দ্রুত বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। সর্বকালের মুসলিমদের জন্য সেটিই হলো নবীজী (সা:)র সর্বশ্রেষ্ঠ লিগাসী ও সূন্নত।
সাফল্যের পথ ও ব্যর্থতার পথ
নবীজী (সা:)’র ইসলামের পথটিই সাফল্যের একমাত্র পথ। সেটি প্রমানিত। আজকের মুসলিমদের পথটি নিশ্চিত ব্যর্থতার। সেটিও প্রমাণিত। আজকের মুসলিমগণ কেন ব্যর্থ -সেটিও সুস্পষ্ট। কারণ, তারা অজ্ঞতার বিরুদ্ধে জিহাদে নাই; বরং হাবুডুবু খাচ্ছে জাহিলিয়াতের জোয়ারে। কারণ, তাদের হাতে জাহিলিয়াত নির্মূলের মোক্ষম অস্ত্র পবিত্র কুর’আন নাই। কুর’আন তেলাওয়াত করলেও তারা সেটি বুঝে না। ফলে তারা ইতিহাস গড়েছে কুর’আনের প্রতি অবমাননায়। শিক্ষাদানের নামে ছাত্রদের হাতে যেসব বই তুলে দেয়া হচ্ছে তাতে দেশে-বিদেশ চাকুরি-বাকুরি ও উপার্জনের কিছু সামর্থ্য বাড়লেও জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সামর্থ্য আদৌ বাড়ছে না। ফলে তথাকথিত ডিগ্রিধারী শিক্ষিতরা বাঁচছে অজ্ঞতার জঞ্জাল হৃদয়ে ধারণ করেই। সেটি বুঝা যায় জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজম ইত্যাদি নিষিদ্ধ মতবাদের স্রোতে ভাসতে দেখে। ফলে তারা নিজেরা ইসলামের পক্ষের সৈনিক না হয়ে শয়তানের পক্ষের সৈনিকে পরিণত হয়েছে। ফলে তারা ইসলামের বিজয় না বাড়িযে পরাজয় বাড়িয়েছে। তাদের কারণেই মুসলিম বিশ্বে নবীজী (সা:)’র ইসলাম বেঁচে নাই। বরং বিজয় পেয়েছে জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদ, রাজতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদ, সেক্যুলারিজম, পুঁজিবাদ ইত্যাদি নানা প্রকার জাহিলিয়াত। মূর্তিপূজার স্থান নিয়ে জাতিপূজা, গোত্রপূজা, ভাষা পূজা, বর্ণ পূজা ও ভূগোল পূজা। ফলে তাদের হাতে পূজার সংস্কৃতি বিলুপ্ত না হয়ে বলবান হয়েছে।
যারা প্রকৃত মুসলিম রূপে বাঁচতে চায় এবং মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ চায়, তাদের কাজের শুরুটি হতে হবে সেখান থেকেই যেখান থেকে শুরু করেছিলেন নবীজী (সা:) এবং তাঁর সাহাবাগণ। পরিশুদ্ধ ব্যক্তি, পরিশুদ্ধ সমাজ ও পরিশুদ্ধ রাষ্ট্র নির্মাণে সেটিই হলো নবীজী (সা:) ও তাঁর সাহাবাদের সূন্নত। নবীজী (সা:)’র পথটিই হলো সাফল্যের একমাত্র পথ। সে পথের মূল কথাটি হলো, মুসলিমদের মুসলিমের স্তরে না রেখে তাদেরকে দ্রুত পৌঁছাতে হবে মু’মিন ও মুত্তাকীর স্তরে। সে কাজটি দেশে শুধু মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যায় বৃদ্ধি এনে সম্ভব নয়। শুধু নামাজী, রোজাদার ও হাজীর সংখ্যা বাড়িয়েও সম্ভব নয়। তাদের প্রত্যেককে আলোকিত করতে হবে পবিত্র কুর’আনর জ্ঞানে। এখানে ব্যর্থ হলে ব্যর্থ হবে পূর্ণ মুসলিম রূপে বেড়া উঠার কাজ। কারণ, একমাত্র কুর’আনী জ্ঞানে আলোকিত মানুষই সত্যিকার মুমিন ও মু্ত্তাকী হয়। সে আলোকিত করার কাজটি না হলে বিপুল সংখ্যক মানুষ নামাজী, রোজাদার ও হাজী হয়েও বেঈমান হয় এবং রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে ইসলামের শত্রুতে পরিণণ হয়। আজ তো সেটিই হচ্ছে। বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশগুলিতে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই তো এরাই করছে। তাই প্রতিটি মানব সন্তানকে অনাহার থেকে বাঁচানো যেমন ফরজ, তেমনি ফরজ হলো জাহিলিয়াত থেকে বাঁচানো। কিন্তু সে কাজটি মুসলিম দেশগুলিতে হচ্ছে না। ফলে রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কল কারখানা নির্মাণের কাজ হলেও আলোকিত মানুষ নির্মাণের কাজটি হচ্ছে না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এলেও গভীর জাহিলিয়াত থেকে যাচ্ছে চেনতনার ভূমিতে। মুসলিম উম্মাহর সকল ব্যর্থতার শুরু তো ঈমানদার মানব রূপে বেড়ে উঠার ব্যর্থতা থেকেই।
বুঝতে হবে, নবীজী (সা:) আরব মুসলিমদের শুধু কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি। নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত দিয়েও তাদের যাত্রা শুরু করেননি। বরং নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত ফরজ করার আগে তাদের মনকে আলোকিত করা হয়েছিল পবিত্র কুর’আনের জ্ঞানার্জন ফরজ করে। সে কুর’আনী জ্ঞানই তাদেরকে মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার সাথে একাত্ম করে এবং মুমিন ও মুত্তাকীর পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। সেসব মুত্তকীগণই আল্লাহ তায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার লড়াইয়ে লড়াকু সৈনিকে পরিণত হয়। সে জিহাদের পথ ধরেই প্রতিষ্ঠা পায় ইসলামী রাষ্ট্র এবং বিজয় পায় শরিয়া, সুবিচার ও প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্ব। এবং সে পথ ধরেই মুসলিম উম্মাহর উদ্ভব হয় বিশ্বশক্তি রূপে। অথচ আজকের মুসলিমগণ নবীজী (সা:)’র সে পথে নাই।
নবীজী (সা:)’র পথটিই তো পরিশুদ্ধ ব্যক্তি, পরিশুদ্ধ সমাজ ও পরিশুদ্ধ রাষ্ট্র নির্মাণের একমাত্র সফল রোডম্যাপ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বাঙালি মুসলিমগণ নবীজী (সা:)’র সে রোডম্যাপ ছেড়ে বেছে নিয়েছে পতনের রোডম্যাপ। সে রোডম্যাপ বেয়েই তারা দুর্নীতিতে বিশ্বে ৫ বার প্রথম প্রথম হয়েছে। আরো পরিতাপের বিষয় হলো, পতনের সে পথটি তারা আজও ছাড়তে রাজী নয়। কারণ, মদ্যপান ও ড্রাগ সেবনের ন্যায় পতনের পথে চলার মধ্যেও যে প্রচণ্ড নেশাগ্রস্ততা আছে -সেটিই তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। তাই এখনো বিপুল সংখ্যক বাঙালি মুসলিম প্রচণ্ড নেশাগ্রস্ত বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও বামধারার রাজনীতিতে। ফলে ইসলাম এখনো তাদের কাছে অতি অসহ্য। পাহাড়ের চুড়া থেকে কোন পাথর খণ্ডকে ছেড়ে দিলে সেটি যেমন গড়িয়ে নিচে নামতে থাকে, তেমনি লাগাতর নিচে নামছে মুসলিম উম্মাহ। তাই আজ থেকে শত বছর আগে মুসলিম উম্মাহ যতটা ইসলামের কাছে ছিল আজ তা থেকে অনেক দূরে। ফলে শত বছর আগে বাঙালি, পাঞ্জাবী, পাঠান, বিহারী, গুজরাতী, সিন্ধি, বেলুচ, অসমিয়া ইত্যাদি পরিচিয়ের মুসলিমগণ যেরূপ প্যান-ইসলামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিম লীগের পতাকা তলে জমায়েত হয়েছিল এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়েছিল -আজ সেটি কল্পনাও করা যায়না। আজ নেশাগ্রস্ত বিভক্তি মানচিত্র পূজায়।
কুর’আনই মোক্ষম বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র
মানব জীবনের সবটুকুই সময়ই মূলত যুদ্ধময়; সেটি ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি ও সংস্কৃতির অঙ্গণ জুড়ে। বস্তুত জীবনের প্রথম যুদ্ধটি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধটি হয় জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে। তাই একজন মুসলিমকে তার জীবনের শুরু থেকেই মুজাহিদ হতে হয়। মুসলিম জীবনে নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার কোন স্থান নাই। জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধকে সুরা ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে জিহাদে কবির তথা বড় জিহাদ বলা হয়েছে। বলা হয়েছে:
فَلَا تُطِعِ ٱلْكَـٰفِرِينَ وَجَـٰهِدْهُم بِهِۦ جِهَادًۭا كَبِيرًۭا
অর্থ: “অতঃপর তোমরা কাফিরদের অনুসরণ করো না, এবং এই কুর’আন দিয়ে বড় জিহাদটি করো।”
মহান আল্লাহ তায়ালার হিকমত হলো, তিনি যেমন জিহাদকে ফরজ করেছেন, তেমনি সে জিহাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্রও মুসলিমদের হাতে তুলে দিয়েছেন। আর সে মোক্ষম অস্ত্রটি হলো পবিত্র কুর’আন। আলো যেমন রাতের অন্ধকার দূর করে, কুর’আনী জ্ঞানের আলো তেমনি মনের অন্ধকার দূর করে। মনের অঙ্গণে জাহিলিয়াত তথা অজ্ঞতা নিয়ে আর যাই হোক মুসলিম হওয়া যায়না। তাই মুসলিম হতে হলে প্রথমে দিল সাফ করতে হয়, তথা মন থেকে অজ্ঞতা সরাতে হয়। এখানেই পবিত্র কুর’আনের গুরুত্ব। কুর’আনের জ্ঞান ছাড়া এ কাজটি হয়না। এজন্যই নামাজ-রোজা ফরজ করার আগে সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জন ফরজ করেছেন। অথচ পরিতাপের বিষয় হলো, আজকের মুসলিমগণ কুর’আন না বুঝে এবং মন থেকে জাহিলিয়াতের জঞ্জাল দূর না করেই মুসলিম হতে চায়। ফলে তারা বাঁচছে জাতীয়তাবাদী, বর্ণবাদী, গোত্রবাদী ও বামপন্থীদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এবং তাদের সৃষ্ট রাজনৈতিক স্রোতে ভেসে। বাংলাদেশসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশে তো তাদেরই বিজয়। অথচ যারা জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাজিত হয় তাদের পক্ষে অসম্ভব হয় সিরাতাল মুস্তাকীমে চলা। তারা সহজে পথ হারায় এবং ছিটকে পড়ে জাহান্নামের পথে। অপর দিকে যারা জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে জিহাদে বিজয়ী হয়, একমাত্র তারাই ইসলামকে বিজয়ী করার প্রতিটি রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সশস্ত্র জিহাদের লড়াকু মুজাহিদ হয়।
মুসলিম হওয়ার অর্থই আমৃত্যু জিহাদ নিয়ে বাঁচা
সংঘাতময় এ পৃথিবীতে মুসলিম কখনোই নীরব ও নিষ্ক্রিয় হতে পারে না। নবীজী (সা:)’র কোন সাহাবীই নীরব ও নিষ্ক্রিয় ছিলেন না, তাদের সবাই জিহাদ করেছেন এবং অর্ধেকের বেশী সাহাবা শহীদ হয়েছেন। পৃথিবীর বিশাল মানচিত্রের ভূ-রাজনীতি তো তারাই বদলিয়ে দিয়েছেন। সেটি আজ ইতিহাস। কিন্তু আজকের মুসলিম বাঁচছে নতুন ইতিহাস নিয়ে। সেটি ইসলামের মিশন থেকে দূরে থাকার। অথচ মুসলিম হওয়ার অর্থই হলো, মিথ্যা ও অসত্যের বিরুদ্ধে আমৃত্যু জিহাদ নিয়ে বাঁচা। প্রাথমিক পর্যায়ে সে জিহাদটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক। যার হাতে সে জিহাদের অস্ত্র পবিত্র কুর’আন নাই, তার জন্য পরাজয় সুনিশ্চিত। সে তখন ভেসে যায় সমাজে বহমান জাহিলিয়াতের স্রোতে। সেটি বাঙালি মুসলিম জীবনে প্রকট ভাবে দেখা যায়। তাই লক্ষ লক্ষ বাঙালি ভেসে গেছে জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, সেক্যুলারিজম ও বাধপন্থী ধারার স্রোতে এবং ১৯৭১’য়ে তাদের দেখা গেছে পৌত্তলিক ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদেরকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করতে। মগজে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকলে কেউ কি এমন হারাম কাজ করে? ঈমানকে বাঁচিয়ে রাখে ও পরিপুষ্টি দেয় তো পবিত্র কুর’আনের জ্ঞান -যা বলা হয়েছে সুরা আনফালে ২ নম্বর আয়াতে। বলা হয়েছে:
إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ ٱللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ ءَايَـٰتُهُۥ زَادَتْهُمْ إِيمَـٰنًۭا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ ٢
অর্থ: মু’মিন তো একমাত্র তারাই যাদের ক্বালব ভয়ে কেঁপে উঠে -যখন তাদের সামনে আল্লাহর নামের যিকির করা হয়; এবং যখন তাদেরকে কুর’আনের আয়াত তেলাওয়াত করে শুনানো হয়, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায়। এরাই হলো তারা যারা তাদের প্রতিপালক রব’য়ের উপর ভরসা করে।”
কুর’আনের জ্ঞান তাই ঈমানের পুষ্টি জুগায়। এবং যারা বাঁচে কুর’আনী জ্ঞানের শূণ্যতা নিয়ে, তাদের মগজ পরিণত হয় ঈমানের কবরস্থানে। ফলে নামাজ-রোজা ও হজ্জ-যাকাত পালন করেও এরা ঈমানদার হতে পারে না। মৃত ঈমানের এই মানুষগণ রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে শরিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, পৌত্তলিক ভারতকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করবে, পাকিস্তানের ন্যায় মুসলিম রাষ্ট্রের খণ্ডিত করণকে দেশপ্রেম বলবে এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পবিত্র জিহাদকে সন্ত্রাস বলবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? বাংলাদেশের রাজনীতি তো এই মৃত ঈমানের বেঈমানদের দখলে।
বাঙালি মুসলিমদের এরূপ ন্যাক্কারজনক ব্যর্থতার কারণ, তাদের হাতে বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদের অস্ত্রটি তুলে দেয়ার কাজটি আদৌ হয়নি। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাদেরকে কুর’আনের জ্ঞানে মুর্খ বা অজ্ঞ রাখা হয়েছে। মুসলিম শিশুদের কুর’আন তেলাওয়াত শেখানো হলেও তাদের মাঝে কুর’আন বুঝার সামর্থ্য সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে বাংলাদেশের প্রতি এক হাজারের মুসলিমের মাঝে একজনও কি সরাসরি কুর’আনের অর্থ বুঝার সামর্থ্য রাখে? অথচ ইসলামের গৌরব কালে যারা ইসলাম কবুল করেছিল তারা সরাসরি কুর’আন বুঝার লক্ষ্যে নিজেদের মাতৃভাষাকে কবরে পাঠিয়ে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছিল -যেমনটি মিশর, সিরিয়া, ইরাক, সূদান, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, মৌরতানিয়া ও আলজিরিয়ার জনগণ করেছে। ভাষাপ্রেমের চেয়ে আল্লাহপ্রেম তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল। কারণ, জান্নাতের জন্য নিজেদের যোগ্যতর করাটি তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল। ভাষা সে পথে বাধা সৃষ্টি করলে সে ভাষাকেই তা পরিত্যাগ করেছিল। অথচ আজকের মুসলিমগণ চাকুরির বাজারে নিজেদের বাজার মূল্য বাড়াতে ইংরেজী, ইটালিয়ান, চীনা, জাপানী, কোরিয়ান ইত্যাদি ভাষা শিখতে রাজী, কিন্তু কুর’আনের ভাষা শিখতে রাজী নয়। কারণ তাদের কাছে জান্নাত গুরুত্ব পায়নি, গুরুত্ব পেয়েছে এই ইহলৌকিক জীবন। এটিই হলো সেক্যুলারিজম। কুর’আনের সাথে এ গাদ্দারী কি সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা দেখছেন না?
বাঙালি মুসলিমদের ইসলাম চর্চা অতি সীমিত। দোয়া-দরুদ ও ওজিফা পাঠ শেখানো হলেও কুর’আন বুঝার সামর্থ্য সৃষ্টির কাজটি হয়নি। কুর’আন থেকে সরাসরি জ্ঞান আহরণের সামর্থ্য না বাড়িয়ে শুধু তেলাওয়াতের সামর্থ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে তাদের পরাজয়টি বিশাল। তারা ভেসে গেছে ইসলাম বিরোধী রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির স্রোতে। ভাসতে ভাসতে তারা এমন কি ভারতের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ পৌত্তলিক শত্রুদের কোলে গিয়ে উঠেছে এবং তাদের আজ্ঞাবহ সৈনিকে পরিণত হয়েছে - যেমনটি একাত্তরে দেখা গেছে বহু হাজার বাঙালি মুসলিমের জীবনে।
কুর’আন থেকে জ্ঞান লাভ ও জ্ঞানদান: শ্রেষ্ঠতম ইবাদত
মুসলিম জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো কুর’আন থেকে জ্ঞান লাভ ও জ্ঞান দান। এটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত। এ ইবাদতে ব্যর্থ হলে অন্য ইবাদতে সফলতা মেলে নয়। কারণ ইবাদতের প্রাণ হলো তাকওয়া তথা নিজ মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার সঠিক ধারণা এবং তাঁর কাছে হিসাব দেয়ার সার্বক্ষণিক সজ্ঞানতা। আর সে তাকওয়া গড়ে উঠে কুর’আনের জ্ঞানে। কারণ, একমাত্র কুর’আনই মহান রব’য়ের সঠিক পরিচয়টি পেশ করে; এবং সে সাথে দেয় রোজ হাশর ও আখেরাতে জ্ঞান। এবং দেয় জান্নাত ও জাহান্নামের সঠিক বিবরণ। একমাত্র কুর’আনই পথ দেখায় কিরূপে নিয়ামত ভরা জান্নাতে যাওয়া যায়; এবং কিরূপে বাঁচা যায় জাহান্নামের আগুন থেকে। যে ব্যক্তি তার অনন্ত অসীম কালের শেষ ঠিকানার পরিচয়টিই জানে না, সেখানে যাওয়ায় সে আগ্রহী হবে কিরূপে? এজন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জীবনে ইবাদতের শুরুটি করেছিলেন কুর’আন থেকে জ্ঞান অর্জনকে ফরজ করো।
অজ্ঞ ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করা সহজ; যেমন সহজ হলো গরুছাগলকে ইচ্ছামত যে কোন গলি পথে নেয়া। কারণ, নিজ সামর্থ্যে সঠিক পথটি খুঁজে বের করার সামর্থ্য যেমন গরুছাগলের থাকে না, তেমনি থাকেনা অজ্ঞ ব্যক্তিদের। অন্য যে কেউ বন্ধু সেজে সহজেই তাদেরকে ভ্রান্ত পথে নিতে পারে। কোটি কোটি অজ্ঞ মানুষকে জাহান্নামে নেয়া যায় ধর্মবাণীর নামে কিছু পথভ্রষ্ট মানুষের লেখা বইয়ের আজগুবি কিচ্ছা কাহিনী শুনিয়ে। পৌত্তলিক হিন্দুরা তো তাদের সনাতন মিথ্যাকে হাজারো বছর সে পথেই বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু যে ব্যক্তি সঠিক পথটি চেনে, তাকে ভ্রষ্ট পথে নেয়া অসম্ভব। পবিত্র কুর’আন সে সঠিক পথ চেনার সামর্থ্যটিই বাড়ায়। মানব জীবনে সে সামর্থ্যটিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ সামর্থ্য। সে সামর্থ্য যার আছে একমাত্র সেই পায় সিরাতাল মুস্তাকীম চেনা ও সে পথে চলার সামর্থ্য। বিশ্ব বিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকলে কেউ জাহান্নামে যাবে না, কিন্তু নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে যদি সিরাতাল মুস্তাকীম চেনার সে সামর্থ্য না থাকে।
অপরাধ শুধু অনাহারে রাখা নয়, কুর’আনী জ্ঞানে অজ্ঞ রাখাও
পানাহারের পর মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিষয়টি হলো শিক্ষা। কে কতটা দৈহিক সুস্থতা নিয়ে বেড়ে উঠবে, সেটি নির্ভর করে তার সঠিক পানাহারের উপর। এবং কে কতটা নৈতিক সুস্থতা ও মানবিক গুণে বেড়ে উঠবে -সেটি নির্ভর করে তার শিক্ষার উপর। এবং কে কতটা সিরাতাল মুস্তাকীমে চলার সামর্থ্য পাবে এবং জান্নাতের যোগ্য রূপে বেড়ে উঠবে -সেটি নির্ধারণ করে তার কুর’আনী জ্ঞান। তাই যে সরকার মানবের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি করতে চায়, সে সরকার সামর্থ্য বাড়ায় কুর’আন বুঝার। ইসলাম সে কাজটি শুরুতেই করেছে কুর’আন থেকে জ্ঞানার্জনকে ফরজ করে। আর যে সরকার জনগণকে সবচেয়ে বড় অকল্যাণটি করতে চায় অর্থাৎ জাহান্নামের আগুনে নিতে চায় তারা দূরে রাখে কুর’আন থেকে। এটিই শয়তানের ঘোষিত এজেন্ডা। বাংলাদেশে সে কাজটি করেছে ব্রিটিশ কাফির শাসকগণ এবং পরবর্তীতে সেটি করেছে মুসলিম নামধারী সেক্যুলারিস্ট শাসকগণ। ফ্যাসিস্ট হাসিনা তো কুর’আনের তাফসির নিষিদ্ধ করেছে এবং প্রসিদ্ধ মুফাচ্ছেরদের কারাবন্দী করেছে।
শয়তান সহজেই নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করে কুর’আনের জ্ঞানে অজ্ঞ জাহিলদের উপর। ফলে তাদের জন্য কঠিন হয় জান্নাতের পথে চলা। তাই পিতামাতার উপর অর্পিত সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি সন্তানকে শুধু পানাহার, বস্ত্র ও বাসস্থান দেয়া নয়, বরং কুর’আনের জ্ঞান দেয়া। যে সন্তানটি কুর’আনের জ্ঞান পায়, তার জন্য সম্পদ রেখে না গেলেও সে জান্নাতের যোগ্য রূপ বেড়ে উঠার সামর্থ্য পায়। কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে তাকে বাঁচানো কঠিন হয় যদি সে ব্যর্থ হয় কুর’আনের জ্ঞান পেতে। কোটি কোটি টাকার সম্পদও তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে পারেনা। এবং সন্তান যদি জাহান্নামে যায় তবে রোজ হাশরের বিচার দিনে পিতা-মাতাকেও আসামীর কাটগড়ায় দাঁড়াতে হবে; এবং জবাব দিতে হবে দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য। শিশুকে চোখের সামনে পানিতে পড়তে দেখে না বাঁচানো কবিরা গুনাহ। তেমনি কবিবরা গুনাহ হলো নিজ সন্তানকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা না করা তথা কুর’আনের জ্ঞান না দেয়া। কারণ, মহান আল্লাহতায়ালা যখন কাউকে কোন সন্তান দেন, বুঝতে হবে তাঁর জীবনে পরীক্ষাও শুরু হয়েছে। সেটি অভিভাবক রূপে সে কতটা সফল -সেটির। জান্নাতে যেতে হলে এ পরীক্ষাতেও পাশ করতে হয়।