বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির উত্থান, পতন ও প্রভাব

630 views
Skip to first unread message

Isha Khan

unread,
Sep 23, 2016, 1:27:04 PM9/23/16
to

বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির উত্থান, পতন ও প্রভাব -পর্ব ১

কমিউনিষ্ট

উনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালে  ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তি তথা পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বিবেচনা ও গবেষণা করলে দেখা যায়, এতদাঞ্চলে অর্থাৎ ভৌগলিক বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দোলন কখনই শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।…আদর্শগত দ্বন্ধ এবং নেতৃত্বের দুর্বলতা ও টানাপোড়েনের ফলে বামপন্থীরা দেশের সার্বিক রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত ব্যপক গ্রহনযোগ্যতা আদায় করতে পারেনি। গোড়া থেকেই বামপন্থী দলগুলোর পেছনে জনসমর্থনের ভিত্তি ছিল দুর্বল।

বিংশ শতাব্দীর প্রায় সুচনালগ্ন থেকে ভারতবর্ষে বামপন্থী ও বিপ্লবী রাজনীতির গোড়াপত্তন ঘটলেও মুলতঃতা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃত্বাধীন।মুসলিমদের মধ্যে ক্যাডারভিত্তিক কোন বামপন্থী দল গড়ে না ওঠায় পাকিস্তান আমলে এতদাঞ্চলের বামভক্তরা দলীয় সংগঠনের বৃহৎ হিসসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

এতসব স্বত্বেও এ কথাও কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না যে, পাকিস্তান আমলে এতদাঞ্চলে বাম রাজনীতি একরকম নতুনভাবে যাত্রা শুরু করলেও একদিকে নেতৃত্বগত কোন্দল এবং আদর্শগত দন্ধের কারণে বারংবার বামপন্থী দলগুলো হয়েছে দ্বিধাবিভক্ত এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাম চিন্তাধারার প্রতি সামান্য যে সহানুভূতিও ছিল ক্রমশঃ তা অন্তর্হিত হয়েছে। বাংলাদেশে বাম রাজনীতির সংকটের মূল কারণ এখানেই নিহিত।

রাজনৈতিক সংগঠনে নেতৃত্বের কোন্দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অতি সাধারণ ঘটনা।দেশের বামপন্থী মহলও এই অশুভ প্রভাব এড়িয়ে দূরে থাকতে পারেনি।একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বামপন্থী দলগুলোতে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের শ্রেণীগত অবস্থান এর একটা প্রধান কারণ।কোন বামপন্থী নেতাই বুর্জোয়া ধ্যানধারণা থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত কিনা, সে নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।যারা সত্যিকার অর্থেই বামপন্থী চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন,তাঁদের নেই ধারণাবিস্তারের উপযোগী সংগঠন।

ফলে অতি সহজেই আপাতঃবামপন্থীদের মধ্যে স্থান করে নিচ্ছে সুবিধাবাদ-যার ফলে বামপন্থী নেতারাও ক্ষমতার টোপ গিলে ফেলেন অবলীলাক্রমে এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সার্বিকভাবে দেশের বামপন্থী আন্দোলন। এসমস্ত কারণেই বামপন্থী রাজনীতি এতদাঞ্চলে আজ থেকে প্রায় শতাব্দীকাল আগে চর্চা করা হলেও এর অন্তর্নিহিত সংকট কমেনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তা গাঢ়তর হয়েছে।

১৯৯০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ছোট বড় মিলিয়ে বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৮টি।এদের মধ্যে দুটি মূলস্রোত যথাক্রমে মস্কোপন্থী ও বেইজিংপন্থী চিন্তাধারার অনুসারী।বহুধাবিভক্ত ওপর একটি অংশ সনাতনী কায়দায় সন্ত্রাসবাদী  ও সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সামাজিক রুপান্তরে বিশ্বাসী।অপর একটি অংশ মধ্যপন্থী ধারা অনুসরণ করে জাতীয়তাবা্দী চিন্তাচেতনার ভিত্তিতে সমাজ পরিবর্তনে বিশ্বাস করে।এদের মধ্যে ২৫টি দল সাংগঠনিক অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করছে ( জগলুল আলম, বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা ১৯৪৮-৮৯, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, ১৯৯০, পুর্বকথন) ।

ধারাবাহিক এই পর্যালোচনায় আমরা দেখব বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির শুরু,  উত্থান ও পতনের ইতিহাস এবং বর্তমান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিতে তাঁদের কর্মকান্ডের প্রভাব।প্রায় পুরো লেখাটি নেয়া হয়েছে  জগলুল আলম কর্তৃক লিখিত গবেষণা গ্রন্থ  ‘বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা ১৯৪৮-৮৯’ থেকে। 

………………………

সাধারণভাবে বলা যায়, ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস যৌথভাবে কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার প্রকাশ করার পর থেকেই বিশ্বে এতদিন যাবৎ চলে আসা সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় এক বিপ্লবের সুচনা ঘটে।কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, সমাজ ও রাজনীতিতে কালক্রমে যে রুপান্তরের খেলা চলে আসছে, প্রকৃতপক্ষে তা হল সমাজের অভ্যন্তরস্থিত অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফল, অর্থাৎ অর্থনীতিই হল সামাজিক ও রাজনৈতিক সকল পরিবর্তনের নিয়ামক।…অবশ্য এর আগেই অর্থাৎ, ১৮৪৬-৪৭ সালে সমাজতবন্ত্রবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দিতে গিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল কমিউনিস্ট লীগ ( জগলুল আলম, বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির গতিধারা ১৯৪৮-৮৯, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, ১৯৯০, পুর্বকথন)। [ তবে, সাবেক যুগস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক ও নেতা Milovan Djilas মনে করেন মার্কসের থিসিস কোন মৌলিক চিন্তা ছিলনা, রবং ছিল ১৮ শতকের ফরাসি বস্তুবাদী তাত্ত্বিকদের থেকে ধার করা।মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ভ্রান্তি বুঝতে পড়ুন The new CLASS: an Analysis of the Communist System]

১৮৬৪ সালে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর আদলে কার্ল মার্কসের নেতৃত্বে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংঘ।পরবর্তীকালে এটি খ্যাতি লাভ করে প্রথম আন্তর্জাতিক নামে,যা ছিল বামপন্থী আন্দোলনের প্রথম ধারক ও বাহক।১৮৭১ সালে এই প্রথম আন্তর্জাতিক ভেঙ্গে যায়।এর অনেকদিন পরে মার্কস-এর মৃত্যুর পর ১৮৮৯ সালে এংগেলস-এর প্রচেষ্টায় গঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক।উনিশ শতকের শেষদিকে মার্কসবাদ চর্চার জন্যে অনেকগুলো গোপন পাঠচক্র গড়ে ওঠে এবং কলে-কারখানায় কিছু শ্রমিক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। ১৮৯৫ সালে রাশিয়ার লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় লীগ ফর দ্য  স্ট্রাগল ফর দ্য ইমানসিপেশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস।এই সুত্র ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রমশঃ গড়ে উঠতে থাকে গোপন ও প্রকাশ্য বামপন্থী সংগঠন। ( প্রাগুক্ত)

উপমহাদেশে বামপন্থী আন্দোলনের সুত্রপাত

উপমহাদেশ বামপন্থী আন্দোলন শুরু হওয়ার পেছনে মূল প্রেরণা ছিল বৃটিশ শাসকদের পুঁজিবাদী কায়দায় ভারতীয় সম্পদ শোষণের জের ও তাঁর ফলে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদী চেতনা।……বিভিন্ন আন্দোলনগুলোর কথা বাদ দিলে উপমহাদেশে সাংগঠনিকভাবে রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ঘটেছে বিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রাথমিক লগ্নেই-যদিও নানা রকমের প্রতিওবন্ধকতার কারণে বামপন্থীদের আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যুদয়ে কিছুটা বেশী সময় লেগে গেছে। (জগলুল আলম,প্রাগুক্ত, পৃঃ১)

ইতিমধ্যে মার্কসবাদী তত্ত্বের অনুসরণে সোভিয়েত রাশিয়াসহ ইউরোপের আরো কয়েকটি দেশে বিপ্লবের পরিবেশ সৃষ্টি হলেও এতদাঞ্চলেও তাঁর ঢেউ এসে লাগে।বিশেষ করে রাশিয়া ও চীনের বিভিন্নমুখী মার্কসবাদী তত্ত্ব এদেশের যুবমনে প্রবল নাড়া দেয়।…চীনা কমিউনিস্ট নেতা মাও সে-তুং বলেছেন,

“বিপ্লবী তত্ত্ব, ইতিহাসের জ্ঞান এবং বাস্তব আন্দোলনের গভীর উপলব্ধি ছাড়া কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে একটি মহান বিপ্লবে নেতৃত্ত্ব দেয়া ওবিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়” (মাও সে তুং, জাতীয় যুদ্ধে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা, চলন্তিকা বইঘর, ঢাকা)।

সেকারণেই ভারতবর্ষের নব্য বিপ্লবীরাও চীন ও রাশিয়া থেকে গ্রহণ করলেন বিপ্লব ও সংগ্রামের প্রেরণা এবং দেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁর বিশ্লেষণ করে এই উপমহাদেশে শুরু করলেন প্রগতিশীল বৈপ্লবিক কর্মকান্ড।

তাঁরা এ-ও জানতেন যে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে বৃটিশ শক্তিকে পরাভূত করা বাস্তবেই সম্ভব নয় এবং আত্মঘাতী বিপ্লবী তৎপরতা হতে হবে এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল ভিত্তি।এরই সুবাদে ১৯০২ সালে কতিপয় মধ্যবিত্ত হিন্দু শিক্ষিত ব্যক্তির নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘অনুশীলন সমিতি’।কলিকাতায় এই সমিতির উদ্যেগক্তা ছিলেন ব্যরিস্টার প্রমথ মিত্র এবং ঢাকায় পুলিনবিহারী দাস।গুপ্ত সন্ত্রাসী তৎপরতার ওপর ভিত্তি করে বৃটিশ রাজশক্তি ও তাঁর এদেশীয় দালালদের খতম করে ভারতের জন্য স্বাধীনতা আদায় করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। (জগলুল আলম,প্রাগুক্ত, পৃঃ১-২)

অনুশীলন সমিতির মুলনীতি ছিল ছয়টি।সেগুলো হলঃ কেন্দ্রীভূত শক্তিশালী সংগঠন প্রতিষ্ঠা, পরিপুর্ণ বিভাগীয় স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ, চরম গোপনীয়তা অবলম্বন, আত্মত্যাগের দীক্ষা ও সুকঠোর শৃংখলা, বিপ্লবী কর্মকান্ডের ভিতর দিয়ে পার্টির বিকাশ সাধন এবং সুনির্দিষ্ট সাংকেতিক লিপি ও বাক্য প্রশিক্ষণ (আবু জাফর মোস্তফা সাদেক, বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন, চলন্তিকা বইঘর, ঢাকা, ১৯৮৭,পৃঃ২)। এই দল অচিরেই একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয় এবং বৃহত্তর বাংলাদেশের সর্বত্র এর শাখা-প্রশাখা গড়ে ওঠে।এ সমস্ত শাখা সংগঠনের কর্মীরা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সন্ত্রাসমূলক তৎপরতা শুরু করেন। পরবর্তীকালে এই অনুশীলন সমিতির সদস্যদের মধ্য থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে (জগলুল আলম,প্রাগুক্ত, পৃঃ২)। [যদিও নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীরের মতে অনুশীলন সমিতি গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মূলত বঙ্গভঙ্গ রদ ও হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থ হাসিল ]  

বৃটিশ নাগরিক ও পুলিশ এবং তাঁদের সহযোগীদের নির্মুল করা ছিল বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা এবং বরিশাল ছিল এই সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কতকগুলো প্রধান কেন্দ্র(Mohiuddin Ahmed, Radical Politics in Bangladesh, Community Development Library, Dhaka, 1984, Background, P:1)।পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গিয়ে অসংখ্য বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করেন, অনেককেই ফাঁসী দেয়া হয় অথবা দন্ডিত করা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে।

১৯১৭ সালের অক্টোবরে এক সফল মহাবিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রী দল ক্ষমতা দখল করে।এর ফলে ভারতীয় বিপ্লবীরা দু’ভাবে লাভবান হন।প্রথমতঃ রাশিয়ায় সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ভারতীয় বিপ্লবীদের আন্দোলনে প্রবল প্রেরণার সঞ্চার ঘটায় এবং দ্বিতীয়তঃ ভারতীয় বিপ্লবীরা সোভিয়েত বিপ্লবীদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতালাভে সক্ষম হন।

প্রখ্যাত ভারতীয় কমিউনিস্ট বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায় (কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে অগ্রদ্রুতের ভূমিকা পালন করলেও পরবর্তীকালে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন (কারণ তাকে ট্রটস্কিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়- জগলুল আলম,প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩)। সোভিয়েত রাশিয়ায় যান ১৯২০ সালের ১লা অক্টোবর তারিখে।তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভারত থেকে পালিয়ে যাওয়া আরো বেশ কয়েকজন বিপ্লবী।লেনিনের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নে দ্বিমত থাকলেও মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে ১৯২০ সালের ১৭ ই অক্টোবর তাশখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রবাসী শাখা গঠিত হয় (জগলুল আলম,প্রাগুক্ত, পৃঃ৪)।

ডঃ দেবেন্দ্র কৌশিক কর্তৃক আবিষ্কৃত উজবেকিস্তানের মহাফিজখানার তিনটি পৃথক দলিলে দেখা গেছে, উক্ত তারিখে সাতজন সদস্য নিয়ে তিন মাস মেয়াদী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়।এরা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়, এভেলিনা ট্রেন্ট রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বিদেশী স্ত্রী), অবনী মুখার্জী, রোজা ফিটিংগোফ (অবনী মুখার্জীর রুশীয় স্ত্রী), মুহাম্মদ আলী, মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী এবং এম প্রতিবাদী বায়াস্কর আচার্য। মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন (মুজফফর আহমদ, আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, খান ব্রাদার্স এন্ড কোং, ঢাকা, ১৯৭৭,পৃঃ৫৪)।

একই মাসের ১৫ তারিখে কমিউনিস্ট পার্টির সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে আব্দল কাদির সেহরাই, মসউদ আলী শাহ কাজী ও আকবর শাহকে পার্টির সদস্যপদ দেয়া হয় এবং মানবেন্দ্রনাথ, শফিক সিদ্দিকী এবং আচার্যকে নিয়ে পার্টির একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মানবেন্দ্রনাথ রায় কর্তৃক রচিত এবং লেলিন ও স্তালিন কতৃক অনুমোদিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ইশতেহার বের হয় মস্কো থেকে।এটি গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ৩৬ তম অধিবেশনে বিতরণ করা হয়।তবে কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রস্তাব হিসেবে উত্থাপন করা হয়েছিল এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না  (জগলুল আলম,প্রাগুক্ত, পৃঃ৪)।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি একথা স্বতঃসিদ্ধ বলেই ধরে নেয় যে, গুপ্ত ও বেআইনি সংগঠন হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে ব্যপকভিত্তিক কোন রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা করা সম্ভব হবেনা, এবং এদেশের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে মূল নেতৃত্ব দেবে বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোই ……পক্ষান্তরে ধাপভিত্তিক এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে হলেও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে এতদাঞ্চলে বামপন্থী আন্দোলনের সুত্রপাত করার প্রশ্নটি ছিল কমিউনিস্টদের কাছে খুবই জরুরী।সেজন্যই কমিউনিস্ট পার্টি যে কর্মকৌশল অবলম্বন করে সেটি ছিল এই যে,

বুর্জোয়া সংগঠন, যেমন কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করে একদিকে আগে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং অন্যদিকে জনগণের মধ্যে কাজ করে কমিউনিস্ট সংগঠনগুলোর কলেবর প্রসারিত করতে হবে (জগলুল আলম,প্রাগুক্ত, পৃঃ৫)।

১৯২৫ সালের ১লা নভেম্বর কুতুবুদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন হোসেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্তকুমার সরকার ও আবদুল হালীমের উদ্যেগে কলিকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় শ্রমজীবী স্বরাজ পার্টি গঠিত হয়।এর প্রতিষ্ঠাতারা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে একটি রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।কাজী নজরুল ইসলাম এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।১৯২৫ সালেই ভারতীয় কমিউনিস্টরা আত্মগোপন অবস্থায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন (আবু জাফর মোস্তফা সাদেক,প্রাগুক্ত, পৃঃ৯২ )।

১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কৃষ্ণনগরে নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মিলনের এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।এর সভাপতি নির্বাচিত হন ডঃ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত।সম্মেলনে কৃষক ও শ্রমিক দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল। সম্মেলনশেষে বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কুতুবদ্দিন আহমদ ও হেমন্তকুমার সরকার।কিন্তু কার্যতঃ সম্পাদকের দায়িত্ব এসে পরে মুজফফর আহমদের ওপরে (মুজাফফর আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪০৪)।

ইতিমধ্যে অনুশীলন সমিতির অনেক নেতা এসে কৃষক ও শ্রমিক দলে যোগ দেন। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কৃষক ও শ্রমিক পার্টি অঙ্গীভূত হয়ে  ১৯৩০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয় ঘটে। তিনের দশকে এসে বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্ট পার্টির শাখা সম্প্রদারিত হতে থাকে।১৯৩৫-৩৬ সালে যশোর, খুলনা, সিলেট ও ১৯৩৭-৩৮ সালে ময়মনসিং নোয়াখালী, কুমিল্লা, পাবনা, বরিশাল, রাজশাহী, বগুড়া, ফরিদপুর প্রভৃতি স্থানে কমিউনিস্ট পার্টির জেলা কমিটি সংগঠিত  হয় (খোকা রায়, সংগ্রামের তিন দশক, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৬)।

( চলবে )

পরের পর্বঃ

পর্ব ২–আপোষ, সন্ত্রাসবাদী  কর্মকান্ড ও ৪৬ সালের নির্বাচনে পর্ব ৩ঃ সন্ত্রাসবাদী থিসিসের সমালোচনা ও  পুনর্গঠন    পর্ব ৪ঃ নীতিগতভাবে কমিউনিস্টদের আওয়ামীলীগে অনুপ্রবেশপর্ব ৫ঃ অন্তবিরোধের সূত্রপাত 

http://www.muldharabd.com/?p=1241
Reply all
Reply to author
Forward
0 new messages