প্রতারক মুজিব এবং ভারতের একাত্তরের যুদ্ধজয়
ফিরোজ মাহবুব কামাল
www.drfirozmahboobkamal.com/blog/প্রতারক-মুজিব-এবং-ভারতের/
মুক্তিবাহিনীর জন্ম ও তার যুদ্ধ ১৯৭১’য়ে। অথচ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধের প্রস্তুতির শুরু পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই। ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক চক্র কখনোই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা চায়নি; তারা চেয়েছিল অখণ্ড ভারত। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠায় তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। সর্বশক্তি দিয়ে বিরোধীতা করেও তারা ব্যর্থ হয় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা রুখতে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে নতুন ষড়যন্ত্র। সেটি অখণ্ড মানচিত্র নিয়ে পাকিস্তানের বেঁচে থাকাকে অসম্ভব করা। পাকিস্তান ভাঙার এজেন্ডা নিয়ে ভারত ১৯৪৭ সাল থেকেই নিজ প্রকল্পের কাজ শুরু করে; এবং সে লক্ষ্য পূরণে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তর থেকে পার্টনার খুঁজছিল। মুজিব সে ভারতীয় প্রজেক্টের সাথে জড়িত হয় ষাটের দশকেই; মুজিব এবং তার কিছু সামরিক ও বেসামরিক সঙ্গীদের পাকিস্তান ভাঙার আগরতলা ষড়যন্ত্রটি ধরা পড়ে ১৯৬৬ সালে। সে ষড়যন্ত্রের অপরাধে মুজিব ও তার সাথীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
কিন্তু ভাগ্য ক্রমে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলের প্রবল চাপে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। ফলে সে মামলা থেকে মুজিব মুক্তি পায় এবং সে সাথে সুযোগ পায় রাজনীতিতে পুনর্জীবিত হওয়ার। অথচ মামলা চললে মুজিব অপরাধী প্রমাণিত হতো এবং তার প্রাণদণ্ড বা যাবতজীবন কারাদণ্ড হতো। কারণ, ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এমন দেশদ্রোহী অপরাধীদের একই রূপ শাস্তি দেয়া হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র যে মিথ্যা ছিল না -তা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা লে. কর্নেল শওকত আলীর ন্যায় সে মামলার অন্য আসামীরা ১৯৭১’য়ের পর নিজেরাই গর্বভরে স্বীকার করেছে। সে যাত্রায় মুজিব বেঁচে যাওয়ায় তার উপর ভারতের বিনিয়োগ নতুন মাত্রা পায়।
পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি তুলে নিলেও সে ষড়যন্ত্র মাঠে মারা যায়নি। বরং সে ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য ভারত নতুন সুযোগ ও নতুন রাস্তা খুঁজতে থাকে। সে ষড়যন্ত্রের রোডম্যাপে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সীমান্ত রক্ষী ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস’য়ের বাঙালি সৈন্যদের বিদ্রোহ ও যুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তানে পাক আর্মির মাত্র এক ডিভিশন সৈন্য ছিল। সে ক্ষুদ্র পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে তারা একটি সহজ বিজয়ের সম্ভাবনা দেখেছিল। বস্তুত একাত্তরে ভারত সেরূপ একটি পরিকল্পিত যুদ্ধ নিয়েই হাজির হয়। ভারত হাজির হয় ১০ ডিভিশন সৈন্য নিয়ে। পাকিস্তান তার সৈন্য সংখ্যা মাত্র ৩ ডিভিশনে উন্নীত করতে সমর্থ হয়।
১৯৭০ সালে মুজিব ৬ দফা স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাজনীতির গোল পোষ্টই বদলে ফেলে। সেটি বুঝা য়ায় ভারতের সাথে সম্পাদিত আগরতলা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের দিকে মুজিবের ফিরে যাওয়া দেখে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের বিষয়টি মুজিব পুরোপুরি পরিত্যাগ করে। ছাত্র লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে দাবী তোলা হচ্ছিল, মুজিব যেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সকল আলোচনা পরিত্যাগ করে সত্বর স্বাধীনতার দাবী তুলে। একাত্তরের ৩ মার্চ ছাত্র লীগের নেতাকর্মীগণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ। শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে দাবী তোলে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে সামরিক আইন ও সামরিক বাহিনী তুলে নিয়ে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। (সূত্র: Richard Sisson and Leo E. Rose; War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California Press, 1990.) সেটি ছিল বিনা যুদ্ধে সুস্পষ্ট বিচ্ছিন্নতার পথ। মুজিব চাচ্ছিল জাতীয় পরিষদের বৈঠক সত্বর ঢাকাতে ডাকা হোক। মুজিব ভেবেছিল, জাতীয় পরিষদের বৈঠক ঢাকায় বসলে তার দলের সদস্যগণ স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাবে। এমন একটি পরিকল্পনা থাকায় পাকিস্তানের ফেডারেল কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের বিষয় মুজিবের সামান্যতম আগ্রহ ছিলনা।
১৯৭০’য়ের নির্বাচন হয়েছিল সংসদ নির্বাচন শেষে ১২০ দিনের মধ্যে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং সংবিধান প্রণয়ন শেষে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্তটি মেনে নিয়ে। এটিই ছিল নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী ক্ষমতা হস্তান্তরের সর্ব সমর্থিত রোডম্যাপ। সেটির বিষদ বর্ণনা এসেছিল ইয়াহিয়া সরকারের ঘোষিত ৮ দফার Legal Frame Work য়ে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলির সাথে শেখ মুজিব সে রোডম্যাপে স্বাক্ষর করেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনী বিজয়ের পর সে রোডম্যাপের শর্তগুলি শেখ মুজিব পুরোপুরি এড়িয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মুজিবকে তার পূর্বের আরেকটি ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে ওয়াদা দিয়েছিল যে, জাতীয় পরিষদ তথা সংসদের বৈঠকের আগেই তার দলের প্রস্তাবিত সংবিধানটি তাকে দেখানো হবে। কিন্তু মুজিব সে ওয়াদার কথা এড়িয়ে যায়। তাজুদ্দীন এক কদম এগিয়ে গিয়ে বলে সেরূপ কোন ওয়াদাই করা হয়নি। এবং আরো বলে, আওয়ামী লীগ তার সাংবিধানিক প্রস্তাবনা কাউকে দেখাতে বাধ্য নয়। (সূত্র: Chowdhury, G.W; The Last Days of United Pakistan, London: C. Hurst & Company, 1974)। অথচ পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি চাচ্ছিল সংসদের বৈঠকের আগেই আওয়ামী লীগের সাংবিধানিক প্রস্তাবনার উপর আলোচনা ও সমঝোতা হোক। তাদের ধারণা ছিল, সংসদের বাইরে সমঝোতা না হলে ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান রচনা করা অসম্ভব হবে। এব আগে ৯ বছর লেগেছিল পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচনা করতে -যা রচিত হয় ১৯৫৬ সালে। আসল বাস্তবতা হলো, পাকিস্তানের সংবিধান রচনার বিষয়টি মুজিব তার মগজ থেকে বহু আগেই বিদায় দিয়েছিল। তখন মুজিবের একমাত্র এজেন্ডা ছিল পাকিস্তান ভাঙা ও স্বাধীন বাংলাদেশের নির্মাণ।
এক্ষেত্রে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বড় ভুল হলো, ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান থেকে ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রকে পুনর্জীবিত না করা। সে কাজটি করতে এক লাইনের একটি বিবৃতিই যথেষ্ট ছিল। সেটি এই, “১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করা বেআইনী ছিল, তাই সে সংবিধানকে পুনর্জীবিত করা হলো।” তাতে পাকিস্তান মুজিবের ষড়যন্ত্র এবং সাংবিধানিক সংকট থেকে বেঁচে যেত। বস্তুত মুজিব সে সাংবিধানিক সংকট থেকেই ফায়দা নিয়েছে।
১৯৭১’য়ের ২০ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ অবধি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টোর সাথে মুজিবের কয়েক বার বৈঠক হয়। অখণ্ড পাকিস্তান বেঁচে যায় -এমন কোন সমাধানই মুজিব মেনে নিতে রাজী হয়নি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টোর সাথে আলোচনা যাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায় -সে চেষ্টাই লেগে ছিল আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী পক্ষ। তাদের প্রতি মুজিবেরও সম্মতি ছিল। মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা টানিয়ে ইয়াহিয়া খানের সাথে মিটিং করতে যায়। ফলে পরিকল্পিত ভাবেই ব্যর্থ করে দেয় একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি এবং অনিবার্য করে ২৫ মার্চের সামরিক হস্তক্ষেপ। আর ভারতের ইন্দিরা গান্ধির সরকার সেটিই চাচ্ছিল। ১৯৭১’য়ে পার্টনার রূপে ভারতীয় এজেন্ডা পূরণে শরীক হয় মুক্তিবাহিনী। বস্তুত ১৯৭১’য়ের যুদ্ধটি ছিল পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দেয়া ভারতের একটি পূর্ব পরিকল্পিত যুদ্ধ। এমন একটি যুদ্ধের জন্য ভারত ১৯৪৭ সালে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে যুদ্ধটি শুরুর মোক্ষম মওকা পায় ১৯৭১’য়ে। তাই যারা মনে করে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার কারণেই একাত্তরের অনিবার্য হয়েছিল -তারা সত্য বলে না। তারা সে কথা বলে আসল ইতিহাস না জেনেই।