বাংলাদেশে বয়ানের যুদ্ধ এবং ফ্যাসিবাদী বয়ানের নাশকতা

2 views
Skip to first unread message

Firoz Kamal

unread,
Oct 17, 2025, 8:01:29 PMOct 17
to

বাংলাদেশে বয়ানের যুদ্ধ এবং ফ্যাসিবাদী বয়ানের নাশকতা

ফিরোজ মাহবুব কামাল

www.drfirozmahboobkamal.com/blog/বাংলাদেশে-বয়ানের-যুদ্ধ-এ/

 

 

বয়ানের যুদ্ধ ও নাশকতা

 

মানব জাতির ইতিহাস সশস্ত্র যুদ্ধের ইতিহাসে ভরপুর, তবে সে সশস্ত্র যুদ্ধের সাথে থাকে বহু নিরস্ত্র যুদ্ধও। সশস্ত্র যুদ্ধের লক্ষ্য, ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রের উপর দখলদারি। আর নিরস্ত্র যুদ্ধের লক্ষ্য, মানুষের চেতনার ভূমির উপর দখলদারি। অর্থাৎ এটি মানুষের মন জয়ের যুদ্ধ। সশস্ত্র যুদ্ধে বিরতি আছে, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটি অবিরাম। বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধটি হলো বয়ানের যুদ্ধ। ধর্ম, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে সবারই নিজ নিজ বিশ্বাস থাকে। সে বিশ্বাসের উপর নির্মিত হয় নিজস্ব বয়ান। বুদ্ধিবৃত্তিক রণাঙ্গণে তখন শুরু হয় নিজ নিজ বয়ানের যুদ্ধ। বয়ানের যুদ্ধের গুরত্ব অপরিসীম। বয়ানের যুদ্ধে পরাজিত হলে রাজনৈতিক যুদ্ধেও পরাজিত হতে হয়। ইসলামে এ নিরস্ত্র যুদ্ধটিও পবিত্র জিহাদ। মহান আল্লাহ তায়ালা সুরা ফুরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে এ যুদ্ধকে “জিহাদান কবিরা” তথা বড় জিহাদ বলেছেন। আর এ যুদ্ধে অস্ত্র হলো পবিত্র কুর’আন। প্রতিটি ঈমানদারের উপর ফরজ হলো এ যুদ্ধের সৈনিক হওয়া।      

 

পরিতাপের বিষয় হলো, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙালি ফ্যাসিবাদী চক্রটি শুধু দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের উপর দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেনি, একচ্ছত্র দখলদারি প্রতিষ্ঠা করেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণেও। শেখ মুজিব ক্ষমতায় এসেই ইসলামপন্থী দলগুলিকে নিষিদ্ধ করে; কিছু কাল পর নিষিদ্ধ করে বিরোধী মতের সকল পত্র-পত্রিকা। একাত্তরের বয়ান রচিত হয়েছে প্রচুর মিথ্যা কাহিনী দিয়ে। দুর্বৃত্তায়নের শিকার শুধু দেশের রাজনীতি ও প্রশাসন হয়নি, চরম দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গণে। মিথ্যা বয়ান প্রতিষ্ঠার কাজে বই উৎপাদনে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। মুজিবের ন্যায় বাকশালী ফ্যাসিস্ট, গণতন্ত্রের খুনি, ভয়ানক দুর্ভিক্ষের জনক, মিথ্যাবাদী প্রতারক, দুর্নীতির লালন কর্তা ও ভারতীয় এজেন্টকে সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে বই উৎপাদনের কাজটি এক বিশাল শিল্পে পরিণত হয়েছিল। হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে অপরাধী মুজিবের উপর যত বই লেখা হয়েছে তার সিকি ভাগ বইও বিগত হাজার বছরে মহান নবীজী (সা:)’র ন্যায় সর্বশ্রেষ্ঠ মানবকে নিয়ে লেখা হয়নি।        

 

যে কোন দেশের জনগণকে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি নিতে হয় নিজ জাতির অতীত ইতিহাস থেকে ইতিহাস থেকে সে তার শত্রু-মিত্রের পরিচয় পায়। সে সাথে সেখান থেকে সে পায় তার নিজের পরিচয়ও। ইতিহাসের মূল শক্তি হলো তার সত্য বয়ানে। ইতিহাসের কিতাব তখন শ্রেষ্ঠ শিক্ষকে পরিণত হয়। তাই সর্বজ্ঞানী মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ:

 

قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِكُمْ سُنَنٌۭ فَسِيرُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ فَٱنظُرُوا۟ كَيْفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلْمُكَذِّبِينَ

 

অর্থ: “নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্বে বহু যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে, সুতরাং তোমরা এ পৃথিবী পৃষ্ঠে ভ্রমন করো এবং খোঁজ নাও সত্য অস্বীকারকারীদের পরিণাম কি হয়েছিল।” –(সুরা ইমরান, আয়াত ১৩৭)।

 

মহান আল্লাহ তায়ালা উপরিউক্ত আয়াতে নানা জাতির ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। ইতিহাসের থাকে দুটি ধারা: একটি হলো সত্যের পথে চলা সফল ব্যক্তিদের ইতিহাস, অপরটি মিথ্যাচারীদের চরম ব্যর্থতার ইতিহাস। যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তাদের জীবনে অন্য কোন শিক্ষাই কাজ দেয়না। সাফল্যের সঠিক পথটিও তারা জানতে পারে না; ফলে তারা ইতিহাস গড়ে ব্যর্থতায়।

 

তবে মিথ্যা দূষণ হলে ইতিহাসের সে সামর্থ্য থাকে না। মিথ্যায় তখন ঢাকা পড়ে ইতিহাসের মূল শিক্ষণীয় বিষয়গুলি। ইতিহাসের সে মিথ্যা বয়ানকে বিশ্বাস করাও তখন চরম ক্ষতিকর হয়। রাম, রাবন, কৃষ্ণ, গনেশ, শিব ইত্যাদি চরিত্রকে ঘিরে কল্পকথার যে কল্পিত ইতিহাস গড়ে উঠেছিল তা বাঁচিয়ে রেখেছে মূর্তি পূজা, গরু পূজা, সর্প পূজা, লিঙ্গ পূজার ন্যায় সনাতন জাহিলিয়াত। এমন মিথ্যাচার যেমন ধর্মকে ঘিরে হয়েছে, তেমনি হয়েছে রাজনীতিকে ঘিরে। দূষিত খাদ্যের ন্যায় দূষিত ইতিহাসও তখন আবর্জনায় পরিণত হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে সে মিথ্যা দূষণটি বিকট। অথচ ইতিহাসের কাজ হলো জাতির বীরদের সাথে শত্রুদের কাহিনীও জনগণের সামনে তুলে ধরা। অতীতের সাফল্যগুলির সাথে ভুলগুলিও তুলে ধরা  -যাতে ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হয়েছে শেখ মুজিবের ন্যায় এক ফ্যাসিস্ট দুর্বৃত্তকে মহা মানব রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে। সেটি করতে গিয়ে অসংখ্য মিথ্যা কল্পকাহিনী তৈরী করা হয়েছে। এবং হাসিনার আমলে সে দূষিত ইতিহাস স্কুল কলেজে পড়ানো হয়েছে।

 

 

ইতিহাস রচনায় দুর্নীতি ও দুর্নীতির রাজনীতি

 

যে কোন দেশের জনগণের common collective memory তথা চেতনাগত সমতা ও ঐক্য গড়ে উঠে ইতিহাসের বয়ান থেকে। তখন গড়ে উঠে দেশবাসীর মাঝে রাজনৈতিক ঐক্য ও সমঝোতা। অথচ বাংলাদেশে সে কাজটি হয়নি; বরং প্রচণ্ড রাজনীতি হয়েছে ইতিহাস নিয়ে। ইতিহাসের বই পরিণত হয়েছে ঘৃণা ও বিভক্তি সৃষ্টির হাতিয়ারে। ইতিহাসের প্রতিটি পর্বেই দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ থাকে। সেরূপ দুটি পক্ষ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময়ই রয়েছে। একটি ইসলামের পক্ষ এবং অপরটি ইসলামের শত্রু পক্ষ।  এ বিভাজনটি হাজারো বছরের -অর্থাৎ এ ভূমিতে ইসলামের আগমনের পর থেকেই। দুটি পক্ষই ইতিহাসের অংশ। তাই ইতিহাসের বইয়ে শুধু জাতির বীর সন্তান  ও বন্ধুদের পরিচয় মেলে না, শত্রুর পরিচয়ও মেলে।

 

যারা শত্রুদের হাতে নির্যাতিত নিহ হয় -তারা জীবিতদের জন্য অতি অমূল্য শিক্ষণীয় বিষয় রেখে যায়। তাদের সে কাহিনী নিয়েই গড়ে উঠে ইতিহাস। তাই সত্যিকার ইতিহাস শুধু রাজা বাদশাহদের ইতিহাস নয়, বরং সে সব বীর মুজাহিদদের ইতিহাসও। কিন্তু ইতিহাস রচনার কাজে যখন দুর্বৃত্ত শাসকদের হাত পড়ে তখন ইতিহাসের বইয়ে ইতিহাসের মূল নির্মাতারাই বাদ পড়ে। তখন ইতিহাস তার মূল্য হারায়। বদর, ওহুদ, খন্দক, মুতার  ন্যায় যুদ্ধগুলির কাফির প্রতিপক্ষ ও মুসলিম বীরদের না জানলে ইসলামের ইতিহাস জানা হয়না। মুসলিমের ইতিহাস জানা হয় না খৃষ্টান ক্রসেডারদের দখল থেকে জেরুজালেম উদ্ধারকারী গাজী সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীকে না জানলে। তেমনি মুসলিম ইতিহাস অজানা থেকে যায় যদি ইংরেজ ও হিন্দুদের প্রবল বিরোধীতার মুখে মুসলিম লীগের পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস না জানলে। অথচ সেগুলি মুজিব ও হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের রচিত ইতিহাসের বইয়ে স্থান পায়নি। বরং সমগ্র ইতিহাস জুড়ে স্থান পেয়েছে মুজিব ও তার প্রভু ভারতের গুণকীর্তন। যেন বাঙালি মুসলিমের ইতিহাসের শুরু মুজিব ও তার সাহায্য দাতা ভারতের অবদান দিয়ে।

 

 

ইতিহাসে যা গুরুত্ব পায়নি

 

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসন ও ব্রিটিশের সহযোগী হিন্দু জমিদার শাসনের ইতিহাসলব্ধ করুণ অভিজ্ঞতা থেকে। ব্রিটিশ শাসক শক্তি চাষীদের হাত থেকে জমির মালিকানা কেড়ে নিয়ে হিন্দু জমিদারদের জমির মালিক বানিয়েছিল। চাষীদের বানিয়েছিল খাজনা দাতা প্রজায়। মুসলিম শাসনামলে দেশের প্রায় শতকরা ২০ ভাগ কৃষি জমি মসজিদ-মাদ্রাসার জন্য বরাদ্দ ছিল। ব্রিটিশগণ সে জমি কেড়ে নিয়ে জমিদারদের হাতে তুলে দেয় । আঙ্গুল কেটে ধ্বংস করা হয় মুসলিম তাঁতিদের বিস্ময়কর মসলিন শিল্প। ধ্বংস করা হয় রেশম ও মখমল শিল্প। এসব ছিল মুসলিমদের দরিদ্র ও নিরক্ষর বানানোর প্রকল্প। শত্রু শক্তি বিজয় পেলে শুধু স্বাধীনতা কেড়ে নেয় না, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতিও ধ্বংস করে। এবং দূষণ ঘটায় ধর্মীয় বিশ্বাসে। এমন কি পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদদের মতে ১৭০০ সালে মোগল সম্রাট আরোঙ্গজীবের আমলে ভারত বিশ্ব জিডিপির শতকরা ২৬ ভাগ জুগাতো; ১৯৪৭’য়ে ব্রিটিশ আমলে তা শতকরা তিন ভাগে নেমে আসে। সুবে বাংলার একার জিডিপি ছিল সমগ্র ভারতের জিডিপি’র অর্ধেকের বেশি। কিন্তু ব্রিটিশগণ নিজেদের পণ্যের বাজার বাড়াতে গিয়ে বাংলার শিল্পকে ধ্বংস করে। ধ্বংস করে বাঙালি মুসলিমের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে। ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতার লড়াইয়ে যোগ দেয়াতে হাজার হাজার আলেমকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। বহু রক্তপাত, বহু দুঃখ-যাতনার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলিমগণ গড়েছিল সে দীর্ঘ দুঃখের ইতিহাস।

 

১৭৫৭ সালে পরাজিত হওয়াতে তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী বাঙালি মুসলিমগণ সেদিন ইংরেজ দস্যুদের হাতে শুধু স্বাধীনতাই হারায়নি, হারিয়েছিল নিজেদের জায়গা-জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং জগত-বিখ্যাত মসলিন, মখমল ও রেশম শিল্পকে। পূর্ণাঙ্গ মুসলিম রূপে বাঁচা ও স্বপ্ন দেখাই সেদিন অসম্ভব করা হয়েছিল। ইংরেজদের সাহায্যপুষ্ট হিন্দু্গণ পরিণত হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের সার্বক্ষণিক পাহারাদারে। মুসলিমদের স্বাধীনতার বড় শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারাই। সেটি বুঝা যায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে তাদের প্রবল ভাবে খাড়া হওয়াতে। বাঙালি মুসলিমগণ এভাবে ১৯০ বছর যাবত পিষ্ট হয় দেশী ও বিদেশী শত্রুদের পদতলে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুক্তি মেলে ইংরেজ শাসক ও হিন্দু জমিদারদের গোলামী থেকে। কৃষকগণ পায় জমির মালিকানা। বাঙালি মুসলিমগণ পায় পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠি রূপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ।

 

 

 

১৯৪৭’য়ের বয়ান ও অর্জন এবং ১৯৭১’য়ের বয়ান ও অর্জন

 

ব্রিটিশ শাসনামলে  ভারতের অন্য যে কোন প্রদেশের মুসলিমদের তুলনায় বাঙালি মুসলিমদের উপর জুলুমের পরিমাণ ছিল সর্বাধিক। তাদের ঘাড়ে চাপানো হয়েছিল জুলুমের দুটি জোয়াল। একটি ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ দস্যুদের, অপরটি হিন্দু জমিদার শোষকদের। জমিদারদের জুলুম ছিল ইংরেজদের চেয়ে অধিক নৃশংস। রাজনীতি তখন মজলুম মুসলিমের প্রতিরোধের  হাতিয়ারে পরিণত হয়। মুসলিম লীগ সে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়। ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা থেকে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা অবধি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সম্মুখ ভাগে ছিল বাঙালি মুসলিমগণ। হিন্দু-প্রভাবিত কংগ্রেসে তারা যোগ দেয়নি। কারণ কংগ্রেসের রাজনীতির লক্ষ্য ছিল অখণ্ড হিন্দু ভারত নির্মাণ। ১৯৩৭ সালের প্রথম প্রাদেশিক সংসদ নির্বাচন থেকে বাংলার রাজনীতি বাঙালি মুসলিমগণ নিজেরা দখলে নিয়ে নেয় এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু জমিদারদের হাত থেকে কেড়ে নেয় জমির মালিকানা।  এভাবে শুরু হয় বাঙালি মুসলিমদের নবযাত্রা।

১৯৪৭’য়ে বয়ানে অর্জিত হয় পাকিস্তান। বাঙালি মুসলিম পরিণত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠিতে। সুযোগ আসে দেশটির চালকের আসনে বসার। শত শত বছর ধরে অবহেলিত এ জনপদে শুরু হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কিন্তু ১৯৪৭ সালে অর্জিত বাঙালি মুসলিমদের স্বাধীনতা ও নতুন মর্যাদা শত্রুদের ভাল লাগেনি। তাই শুরু হয় পুণরায় গোলাম বানানোর ভারতীয় ষড়যন্ত্র। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান ভাঙার আগরতলার ষড়যন্ত্রের সাথে একাত্ম হয় শেখ মুজিবের ন্যায় আত্মসমর্পিত বহু পূর্ব পাকিস্তানী RAW এজেন্ট। পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ায় সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। কিন্তু সে প্রকল্প নতুন জীবন ফিরে পায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণ ভেসে যায় মুজিবের ৮ আনা সের চাউল এবং সোনার বাংলা বানানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও প্রতারণার স্রোতে। একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণও যে কিরূপে আত্মঘাতী হয় এবং নিজ ভোটে শত্রুদের নির্বাচিত করে -তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ১৯৭০’য়ের নির্বাচন।

 

এ পৃথিবী পৃষ্ঠের অধিকাংশ বিপর্যয়ের মূল কারণ হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছা পূরণের রাজনীতি, ধর্মনীতি ও সংস্কৃতি। কারণ, তাদের অধিকাংশ কখনোই ঈমানদার হয় না। তারা সঠিক পথের অনুসারীও হয়না। বরং জনগণের বেশীর ভাগ অনুসরণ করে তাদের খেয়াশ খুশি ও নিজস্ব চিন্তাভাবনা। অথচ মুজিব জনগণকে সত্য জ্ঞানে আলোকিত না করে ও কল্যাণের পথ না দেখিয়ে নিজে অনুসরণ করেছে অধিকাংশের খেয়াল খুশিকে। অথচ জনগণের অধিকাংশের গড়ে তোলা ফিতনা থেকে সাবধান থাকার জন্য নবীজী (সা:)’র প্রতি মহান আল্লাহ তায়ালার হুশিয়ারি হলো:

 

وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِى ٱلْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ إِن يَتَّبِعُونَ إِلَّا ٱلظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ

 

অর্থ: (হে রাসূল), আর যদি আপনি যমিনে যারা আছে তাদের অধিকাংশের আনুগত্য করেন,  তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা শুধু নিজেদের ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা শুধু অনুমানই করে।” –(সুরা আনয়াম, আয়াত ১১৬)।   

 

১৯৪৭ থেকে আগ্রাসী ভারতের পাকানো পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র ১৯৭১’য়ে সফল হয়। ফলে উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় যে বয়ান ১৯৪৭ সালে পরাজিত হয়েছিল তা ১৯৭১’য়ে বিজয়ী হয়। বাংলাদেশীদের জন্য নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো ভারতীয় হিন্দুদের মনে প্রচণ্ড ইসলাম ভীতি ও মুসলিম ভীতি।  একই রূপ হুমকি পাকিস্তানীদের জন্যও। ফলে ভারতীয়দের রাজনীতিতে থাকে শুধু পাকিস্তানকে নয়, বরং বাংলাদেশকেও দুর্বল করা ও খণ্ডিত করার প্রকল্প। এজন্যই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের মাটিতে শুরু হয় ভারতীয় এজেন্ডা পূরণের নতুন রাজনীতি। সে রাজনীতির মূল কথা ছিল জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্যান-ইসলামী মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনার কবর এবং পাকিস্তানের খণ্ডিতকরণ। ভারতীয় সে রাজনীতির সহযোগী রূপে শরীক হয়  শেখ মুজিবের ন্যায় স্বার্থান্বেষী জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টগণ। তাতে শরীক হয় বাঙালি সেক্যুলারিস্ট ও বাঙালি কম্যুনিস্টগণ। তাদের সম্মিলিত যুদ্ধে ১৯৭১’য়ে পাকিস্তান খণ্ডিত হয়।

 

পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর ভারতীয় নাশকতা শুরু হয় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। চালু হয় বাংলাদেশের মাটিতে দখলদারি, লুণ্ঠন ও শোষণের নীতি। সে ভারতীয় নীতি সফল হওয়ার পরিণতি হলো, শেখ মুজিবের আমলে বাংলাদেশ পরিণত হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ভিক্ষার তলাহীন ঝুড়ি। দুর্ভিক্ষ কবলিত বাংলাদেশী শিশুরা পরিণত হয় বিশ্ব জুড়ে দারিদ্র্যের পোস্টার বয়ে। মুজিবের সোনার বাংলা গড়ার প্রতারণা এভাবেই তার আসল রূপ নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু একাত্তর নিয়ে ভারতসেবী বাঙালিদের বয়ানে সে করুণ ইতিহাসের কোন উল্লেখ নাই। বরং রয়েছে সে আমলকে গৌরবময় করার চেষ্টা।

 

১৯৭২’য়ের জানুয়ারীতে ক্ষমতায় এসেই মুজিব যুদ্ধ শুরু করে গণতন্ত্র, ইসলাম ও বাংলাদেশের শিল্প ও অর্থনীতির বিরুদ্ধে। যে বয়ানের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭’‍য়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, যুদ্ধ শুরু হয় সে বয়ানের নির্মূলে। বয়ান খাড়া করা হয় যেন বাঙালি মুসলিমের স্বাধীনতার শুরু ১৯৭১ থেকে। যেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ অবধি ছিল পরাধীনতার যুগ। অপরাধী রূপে খাড়া করা হয় তাদের -যারা সে পাকিস্তান ভাঙার বিরোধীতা করেছিল। নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় প্রায় দুই লাখের অধিক বিহারীকে। ধর্ষণের শিকার হতে হয় বহু হাজার বিহারী নারীকে। প্রতিটি অবাঙালিকে হারাতে হয় তার গৃহ। এরূপ গুরুতর অপরাধও প্রশংসনীয় কর্ম রূপে গৃহিত হয় একাত্তরের বয়ানে। বাংলাদেশ পরিণত হয় ভারতের গোলাম রাষ্ট্রে এবং কবরে যায় গণতন্ত্র। জাতীয়করণের নামে ধ্বংস করা হয় পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত শিল্প কলকারখানাগুলিকে। সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয় আওয়ামী লীগের দলীয় দুর্বৃত্তদের।

 

শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের নদীপথ, সড়ক পথ, নদী বন্দর, সমুদ্র বন্দর পরিণত হয় ভারতের অধিকৃত ভূমিতে। হাসিনার আমলে ইসলামের পক্ষে কথা বলা, এমন কি কুর’আনের তাফসির ও জিহাদ বিষয়ক বইয়ের প্রকাশনা পরিণত হয় শাস্তি যোগ্য অপরাধে। মাওলনা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মত দেশের প্রখ্যাত তাফসির কারককে আমৃত্যু বন্দী রাখা হয়। ফাঁসিতে ঝুলানো হয় ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদদের। শত শত আলেমকে কারাবন্দী করা হয়। গুম ও হত্যা করা শত শত ভারত বিরোধী রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতাকর্মীকে। কোন সভ্য স্বাধীন দেশে কি এসব ঘটে? অথচ এসবই হলো ১৯৭১’য়ে অর্জন। এবং এর পিছনে কাজ করেছে একাত্তরে মিথ্যা বয়ান। সে বানোয়াট বয়ান সেদিন বাঙালি ফ্যাসিস্টদের অতি অসভ্য ও নৃশংস কর্মকেও জায়েজ করেছিল। পারমাণবিক অস্ত্রের ন্যায় কোন ভয়ংকর যুদ্ধাস্ত্রও নিজ থেকে কারো প্রাণ কেড়ে নেয় না। কিন্তু তা ভয়ংকর গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে যদি সে অস্ত্র বিষাক্ত বয়ানে বিশ্বাসী বর্বরদের হাতে পড়ে। এজন্যই ইসলামে শ্রেষ্ঠ জিহাদ হলো এরূপ মিথ্যা বয়ান নির্মূলের জিহাদ।

 

Reply all
Reply to author
Forward
0 new messages