হারাম রাজনীতি ও ফরজ রাজনীতি
ফিরোজ মাহবুব কামাল
www.drfirozmahboobkamal.com/blog/হারাম-রাজনীতি-ও-ফরজ-রাজনী/
লক্ষণ হারাম রাজনীতির ও হারাম রাজনীতির
প্রতিটি কর্মে ও ভাবনায় মহান আল্লাহ তায়ালার গোলামী নিয়ে বাঁচাই হলো ঈমানদারী। ব্যক্তির রাজনীতির ভুবন সে গোলামীর বাইরে নয়। যাদের জীবনে কিছু ভাবনা, তাড়না ও এজেন্ডা থাকে তাদের জীবনে অবশ্যই রাজনীতি থাকে। কারণ রাজনীতি হলো সে ভাবনা, তাড়না ও এজেন্ডাকে বিজয়ী করার দেয়ার হাতিয়ার। রাজনীতিতে না নামলে সেগুলি মগজেই থেকে যায়। আর ঈমানদার কখনোই ভাবনা, তাড়না ও এজেন্ডা মুক্ত হতে পারে না। সেগুলি সে পায় তাঁর ঈমান থেকে। ঈমান নিয়ে বাঁচার অর্থ শুধু আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল, তাঁর কিতাব, তাঁর ফিরেশতা কুল ও আখেরাতের উপর বিশ্বাস নিয়ে বাঁচা নয়, বরং তাঁর পবিত্র এজেন্ডাকে বিজয়ী করার এজেন্ডা নিয়ে বাঁচাও। মহান আল্লাহ তায়ালার সে এজেন্ডাটি হলো সকল দ্বীন ও সকল মতবাদের উপর তাঁর দ্বীন তথা ইসলামের বিজয়। মহান আল্লাহ তায়ালার সে বহু ঘোষিত এজেন্ডাটি হলো “লি’ইয়ুয হিরাহু আলা দ্বীনি কুল্লিহি।” এ অভিন্ন এজেন্ডার ঘোষণা এসেছে সুরা তাওবা, সুরা আল ফাতাহ ও সুরা সাফ’য়ে। যেমন ঘোষিত হয়েছে:
هُوَ ٱلَّذِىٓ أَرْسَلَ رَسُولَهُۥ بِٱلْهُدَىٰ وَدِينِ ٱلْحَقِّ لِيُظْهِرَهُۥ عَلَى ٱلدِّينِ كُلِّهِۦ وَلَوْ كَرِهَ ٱلْمُشْرِكُونَ ٩
অর্থ: “তিনিই সেই মহান সত্ত্বা তথা আল্লাহ যিনি পথ নির্দেশনা ও সত্য দ্বীনসহ তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন -যেন তা সকল ধর্ম ও সকল মতাদর্শের উপর বিজয়ী হতে পারে; যদিও তা মুশরিকদের কাছে অপছন্দনীয়।” –(সুরা সাফ, আয়াত ৯)।
মুসলিম হওয়ার দায় মহান আল্লাহ তায়ালার উপরিউক্ত এজেন্ডার সাথে একাত্ম হওয়া। এতে অনিবার্য হয় জিহাদ; আর রাজনীতি হলো সে জিহাদেরই অংশ। সে জিহাদে থাকে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধ এবং কখনো বা সেটি সশস্ত্র যুদ্ধে রূপ নেয়। ফলে ঈমানদার হওয়ার অর্থ শুধু নামাজী, রোজাদার, হাজী, আলেম, আল্লামা,পীর, মুফতি বা মসজিদের ইমাম হওয়া নয়, বরং মহান আল্লাহ তায়ালার সে এজেন্ডার সাথে পূর্ণ একাত্ম হয়। এবং যারা একাত্ম হয় তাদের জীবনে জিহাদও শুরু হয়। বস্তুত জিহাদ হলো সে এজেন্ডাকে বিজয়ী করার অপরিহার্য হাতিয়ার; সেটি ঈমানের দৃশ্যমান রূপ -যেমন আগুনের দৃশ্যমান রূপ হলো তার শিখা ও উত্তাপ। বস্তুত ঈমাদের দাবীতে একমাত্র তারাই সত্যবাদী যাদের জীবন রয়েছে জিহাদ। এ বিষয়ে অতি সুস্পষ্ট বয়ানটি এসেছে মহান রব থেকে। বলা হয়েছে:
إِنَّمَا ٱلْمُؤْمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا۟ وَجَـٰهَدُوا۟ بِأَمْوَٰلِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّـٰدِقُونَ ١٥
অর্থ: “ঈমানদার একমাত্র তারাই যারা ঈমান আনলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর, অতঃপর এ নিয়ে আর কোন সন্দেহ পোষণ করলো না এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করলো তাদের সম্পদ ও জানের কুরবানী দিয়ে -ঈমানের দাবীতে এই লোকগুলিই সত্যবাদী।” –(সুরা হুজরাত, আয়াত ১৫)।
উপরিউক্ত আয়াতে এটি সুস্পষ্ট, যারা আল্লাহ তায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদে অর্থ, সময়, মেধা ও রক্তের বিনিয়োগ করে না তারা নামাজী, রোজাদার, হাজী, আলেম, আল্লামা, ইমাম, মুফতি ও পীর হতে পারে, কিন্তু তারা ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী নয়। অর্থাৎ তারা ঈমানদার নয়। ঈমানদার হওয়া কঠিন। কারণ ঈমানদার হতে হলে আল্লাহ তায়ালার দ্বীনকে বিজয়ী করার জিহাদ থাকতে হয় এবং সে জিহাদে জান ও মালের কুরবানী থাকতে হয়। মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে কে কত বড় আল্লামা, পীর, ইমাম বা মুফতি -সে হিসাব হবে না, বরং হিসাব হবে সে কত বড় ঈমানদার সেটির। বাংলাদেশের মূল সমস্যা এখানেই। দেশটিতে নামাজী, রোজাদার, হাজী, আলেম, আল্লামা, পীর, মুফতি বা মসজিদের ইমামদের সংখ্যাটি বিশাল। কিন্তু ঈমানদারের সংখ্যাটি অতি নগন্য। এ জন্যই মহান আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর শরিয়া দেশটিতে বেঁচে নাই; এবং সেগুলির প্রতিষ্ঠার জিহাদে মুজাহিদ নাই।
জিহাদ ও যিকির নিয়ে ঈমানদারের রাজনীতি
প্রতিটি কর্মে ও আচরণে মহান আল্লাহ তায়ালার স্মরণকে মগজে নিয়ে চলার মাঝেই প্রকৃত ঈমানদারী। এটিই হলো মুমিনের যিকর। প্রকৃত ঈমানদার তাই যিকরের জন্য জঙ্গলে যায় না বা হুজরায় বসে না, বরং তার যিকর দখা যায় তার কর্ম, বিশ্রাম, পথ চলা. শয়ন কাল এবং পানাহারেও। মহান আল্লাহ তায়ালার নামের যিকর প্রতিপদে যেমন সিরাতুল মোস্তাকীম দেখায়, তেমনি পাপ থেকেও দূরে রাখে। ফলে এরূপ বাঁচায় বিচ্যুতি আসে না। প্রতিক্ষণ এরূপ যিকির নিয়ে বাঁচা এবং বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার মাঝে দৃশ্যমান হয় ব্যক্তির তাকওয়া। এমন তাকওয়া নিয়ে যারা বাঁচে পরকালে তারাই জান্নাতে পৌঁছে। মহান আল্লাহ তায়ালার সে স্মরণটি না থাকার বিপদটি ভয়ংকর। শাস্তি স্বরূপ তখন ঘাড়ের উপর সাথি রূপে জুটে শয়তান; এতে অসম্ভব হয় জান্নাতের পথে চলা। এ প্রসঙ্গে ভীতিকর ঘোষণাটি এসেছে নিচের আয়াতে:
وَمَن يَعْشُ عَن ذِكْرِ ٱلرَّحْمَـٰنِ نُقَيِّضْ لَهُۥ شَيْطَـٰنًۭا فَهُوَ لَهُۥ قَرِينٌۭ ٣٦
অর্থ: “এবং যে ব্যক্তি ভুলে থাকলো রহমানের যিকর তথা স্মরণ থেকে, তার উপর চাপিয়ে দেই শয়তানকে। সে তখন তার সঙ্গী হয়ে যায়।” –(সুরা জুখরুফ, আয়াত ৩৬)।
রাজনীতি হলো মানব জীবনের অতি গুরুত্বর্ণ কর্ম। এখানে বিনিয়োগ হয় কোটি কোটি মানুষের ভোটই শুধু নয়, বরং শ্রম, অর্থ, মেধা ও সময়। থাকে হাজার হাজার মানুষের প্রাণের কুরবানী। রাজনীতি থেকেই নির্ধারিত হয় দেশ ও দেশবাসীর ভাগ্য। নির্ধারীত হয় দেশের বুকে কার নীতি, আদর্শ ও আইন প্রতিষ্ঠা পাবে -সে বিষয়টি। তাই রাজনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি কখনোই আল্লাহ তায়ালার যিকর মুক্ত হতে পারে না। যে রাজনীতিতে মহান আল্লাহ তায়ালার যিকর থাকে না, সে যিকরশূণ্য রাজনীতির উপর দখল নেয় শয়তান ও তার অনুসারীরা।
বুঝতে হবে পশুর গোশতো তখনই হালাল হয়, যখন জবাইটি হয় বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবর বলে। আল্লাহর নামের যিকর না হলে সে পশু জবাই কখনোই হালাল হয়না। বিষয়টি সত্য রাজনীতির বেলায়ও। রাজনীতি একমাত্র তখনই হালাল হয় যখন তাতে থাকে মহান আল্লাহ তায়ালার যিকর; এবং নিয়ত থাকে ইসলামকে বিজয়ী করা। এ রাজনীতিতে তাই জয় বাংলা বা জয় হিন্দ থাকে না। বরং থাকে আল্লাহ আকবর তথা আল্লাহ তয়ালার এজেন্ডাকে বিজয়ী করার অঙ্গীকার। যে রাজনীতিতে সে অঙ্গীকার নাই -সে রাজনীতি হারাম।
হালাল রাজনীতি মাত্রই জিহাদ
রাজনীতিতেই প্রকাশ পায় ব্যক্তির অদৃশ্য ঈমান। প্রকাশ পায় সে কোন পক্ষের সৈনিক। মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডাটি যেমন শিক্ষা-সংস্কৃতি, আদালত, প্রশাসন ও যুদ্ধ-বিগ্রহে আছে, তেমনি আছে রাজনীতিতেও। সত্যিকার ঈমানদার মাত্রই সে রাজনীতিতে হাজির হয় মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষিত সে এজেন্ডাটি নিয়ে। সে রাজনীতি কখনো চলে নিরস্ত্র পথে, কখনো বা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। দেশ কোন দিকে ধাবিত হবে সে ফয়সালাটি গৃহিত হয় রাজনীতির অঙ্গণে; ক্ষেত-খামার বা কল-কারখানাতে নয়। তাই কৃষি, শিল্প বা বাণিজ্যের চেয়েও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনীতি। এবং গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনীতির হালাল হওয়ার বিষয়টি। কারণ, রাজনীতি হালাল না হলে সে হারাম রাজনীতে বিজয়ী হয় শয়তানের পক্ষ। তখন সে হারাম রাজনীতির পরিনামটি জাহান্নাম। বস্তুত রাজনীতি তখনই হালাল হয় যখন সে রাজনীতির নিয়ত হয় ইসলামের বিজয় এবং শরিয়তের প্রতিষ্ঠা। এবং থাকে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের নির্মূলের অঙ্গীকার। এমন রাজনীতি শুধু হালালই নয়, বরং ফরজ প্রতিটি ঈমানদারের উপর। এমন রাজনীতিতে শুধু ভোট দিলে চলে না, বরং অর্থ, সময়, মেধা ও জানের বিনিয়োগও করতে হয়।
হারাম হলো সেক্যুলার রাজনীতি
ব্যক্তির প্রতিটি সামর্থ্যই হলো মহান আল্লাহ-প্রদত্ত আমানত। সে আমানতের বিনিয়োগটি মহান আল্লাহর এজেন্ডার বিজয় ছাড়া অন্য খাতে হওয়াটি হারাম। সেটি মহান রব’য়ের দেয়া আমানতের খেয়ানত। ইসলামী আক্বীদার এটি অতি মৌলিক বিষয়। সেক্যুলার রাজনীতিতে ইসলামের বিজয়ের সে অঙ্গীকার থাকে না। সেক্যুলারিস্টদের নীতি হলো, রাজনীতিতে ধর্মের কথা, আখেরাতের ভাবনা, শরিয়া’র কথা আনা যাবে না। ফলে তাদের যুদ্ধটি মহান রব’য়ের এজেন্ডার বিরুদ্ধে। সেক্যুলার রাজনীতি বিজয়ী হলে পরাজিত হয় ইসলাম। এ রাজনীতি হারাম। তাই কোন ঈমানদার এ রাজনীতিতে জড়িত হতে পারে না। সেক্যুলার রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন করা এবং তাদের প্রার্থিদের ভোট দেয়া হারাম।
পবিত্র কুর’আনের সুরা মুদাছছেরের ৩ নম্বর আয়াতে ঘোষিত হয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ:
وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ অর্থ: “এবং তোমার রব যে আকবর তথা সর্বশ্রেষ্ঠ -সেটির ঘোষণা দাও।”
উপরিউক্ত আয়াতে এ কথা বলা হয়নি যে, আল্লাহু আকবার শুধু আযানে ও নামাজে বলতে হবে। বরং ঈমানদারকে আল্লাহু আকবার বলতে হয় তার রাজনীতি, বুদ্ধিবৃত্তি, সংস্কৃতি, যুদ্ধ-বিগ্রহসহ জীবনের প্রতিটি অঙ্গণে। তবে এ ঘোষণাটি দেয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গণ হলো রাজনীতির মাঠ-ময়দান। রাজনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটিকে ঈমানদারগণ কখনোই অন্য ধর্ম বা অন্য মতাদর্শের অনুসারীদের জন্য ছেড়ে দিতে পারে না। সেটি গণ্য হয় শত্রুর কাছে পরাজয় বা আত্মসমর্পণ রূপে। বস্তুত মুসলিমের রাজনীতির মূল প্রত্যয়, মূল স্লোগান ও মূল যিকর হলো আল্লাহু আকবার। যে রাজনীতিতে সে প্রত্যয় বা বিশ্বাস পরিত্যক্ত হয় -সে রাজনীতি কখনোই হালাল হয়না।
তাই বেঈমানের রাজনীনিতে ভাষা, দেশ, নেতা বা দলের নামে জয়োধ্বনি উঠলেও মুসলিম চিরকালই রাজপথে ও রণাঙ্গণে আল্লাহু আকবার বলেই গগনবিদারী আওয়াজ তুলেছে। তাই বাংলার মুসলিমগণ অতীতে কখনোই কংগ্রেসী হিন্দুদের সাথে গলা মিলিয়ে বন্দেমাতরম বা “জয় হিন্দ” বলেনি, বরং ধ্বনি তুলেছে “আল্লাহু আকবার’য়ের। সে অভিন্ন কারণে “জয় বাংলা” বলার রাজনীতিও হালাল হয় না। কারণ “জয় বাংলা”র রাজনীতিতে বাদ পড়ে মহান আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার অঙ্গীকার। তাতে ধ্বণিত হয় দেশ বন্দনার চেতনা। ব্যক্তি তার গলায় আওয়াজ তোলার সামর্থ্যটি দেশের মাটি বা আলো-বাতাস থেকে পায়না, সেটি পায় একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা থেকে। তাই সে সামর্থ্যটি ব্যয় করতে হয় আল্লাহু আকবর বলায়, জয় বাংলা বলাতে নয়। মুমিনের রাজনীতিতে এভাবেই দৃশ্যমান হয় তাঁর ঈমান ও তাকওয়া। রাজনীতি তখন ঈমানদারের জিহাদ ও যিকরে পরিণত হয়। বেঈমানের রাজনীতিতে সেটি অকল্পনীয়।