একাত্তরে ইসলামপন্থীরা কেন অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিল?
ফিরোজ মাহবুব কামাল
www.drfirozmahboobkamal.com/blog/একাত্তরে-ইসলামপন্থীরা-কে/
হারাম কখনোই হালাল
যা হারাম, তা চিরকালই হারাম। তা কখনোই হালাল হয়না। মদ, জুয়া, শুকুরের গোশতো, জ্বিনা কখনোই হালাল হবে না। চিরকাল এগুলি হারামই থাকবে। কারণ এটিই হলো ইসলামী বিধান। এ বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে -সে আর মুসলিম থাকে না। সে বিদ্রোহী কাফির হয়ে যায়। সে কাফির ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম রূপে দাবী করলে বুঝতে হবে সে মুনাফিক তথা কাফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট। তেমনি হালাল হয় না মুসলিম দেশ ভাঙার হারাম যুদ্ধ ও কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশের ন্যায় বহু মুসলিম দেশে দেহ ব্যবসা, মদ্যপান, সূদী ব্যাংক, জুয়ার প্রচলন টিকে আছে বলেই এগুলি কখনো জায়েজ হয়ন। তেমনি আরবগণ ২২ খণ্ডে এবং মুসলিম বিশ্ব ৫০খণ্ডের বেশী খণ্ডে বিভক্ত বলেই কোন মুসলিম দেশ ভাঙা জায়েজ হয় না। অর্থাৎ কোন একটি হারাম কর্ম নিয়ে যদি বিশ্বের শতকরা ৯৯ ভাগ লোকও বাস করে, তবুও সেটি হালাল হবে না। এটি ইসলামের অতি মৌল কথা, এখানে কোন আপোষ চলে না। আপোষ করলে সে আর মুসলিম থাকে না। পবিত্র কুর’আনে মাহে রমযানের এক মাস রোজার হুকুম এসেছে মাত্র একবার -সেটি সুরা বাকারায়। আর তাতেই রমযানের রোজা ফরজ হয়ে গেছে। অথচ “একতাবদ্ধ থাকো” এবং “বিভক্ত হয়ো না” পবিত্র কুর’আনে মুসলিমদের প্রতি সে হুকুম এসেছে বহুবার। যেমন এসেছে সুরা আল ইমরানের ১০৩ ও ১০৫ নম্বর আয়াতে। তাই পাকিস্তানের মত একটি মুসলিম দেশ ভাঙা জায়েজ হয় কি করে?
যে কোন মুসলিম দেশে বৈষম্য, অনাচার, অবিচার, দুঃশাসন বা গণহত্যার ন্যায় হারাম কর্ম থাকতেই পারে, তবে সেগুলির সমাধান কখনোই দেশ ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে হয়না। ইসলামে ফরজ হলো অন্যায়-অবিচারের নির্মূলের জিহাদ। দেশ ভাঙলে বরং দেশবাসীর স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা সংকটে পড়ে। ইসলাম তাই দেশ ভাঙার ন্যায় গুরুতর হারাম কর্মকে কখনোই জায়েজ করে না। ইসলাম সরকার পরিবর্তনের জন্য লড়াইয়ের অনুমতি দেয়, কিন্তু অনুমতি দেয় না মুসলিম দেশ ভাঙার। বহু অনাকাঙ্খিত জুলুম ও অপরাধ কর্ম ঘটেছে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া খেলাফতের আমলেও। কোন বিজ্ঞ আলেমই সেগুলিকে দলিল বানিয়ে মুসলিম দেশ ভাঙাকে জায়েজ করেননি। ভারতের ন্যায় বহু অমুসলিম দেশেও সেরূপ অপরাধ অহরহ ঘটে। কিন্তু সেগুলি দেশ ভাঙ্গার দলিল রূপে বিবেচিত হয়নি। কিন্তু বাঙালি ফ্যাসিস্ট, বাঙালি সেক্যুলারিস্ট ও বাম ধারার বাঙালি কাপালিকগণ সেগুলিকে পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে দলিল বানিয়েছে। কারণটি সুস্পষ্ট। ইসলামের এ শত্রুদের লক্ষ্য জনগণকে গণতন্ত্র, সুশাসন ও সুবিচার দেয়া ছিল না, বরং এজেন্ডা ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে খণ্ডিত করে মুসলিম উম্মাহকে দুর্বল করা। এভাবেই সেদিন তারা শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করেছিল। অথচ এ পথটি কখনোই কোন ঈমানদারের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এবং একাত্তরেও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
দু’টি বিকল্প পথের মুখোমুখী
একাত্তরে বাঙালি মুসলিমগণ দুইটি ভিন্ন পথের মুখোমুখী এসে খাড়া হয়। একটি পথ ছিল, পাকিস্তান ভাঙার পথ। সে পথটি ছিল ভারতে গিয়ে ট্রিনিং নেয়া এবং ভারতের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ভারতীয় পৌত্তলিক বাহিনীর পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরের ঢুকে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থী বাঙালি মুসলিমদের ইচ্ছামত হত্যা করা। একাত্তরে যারাই ছিল পাকিস্তানপন্থী, বস্তুত তারাই ছিল ইসলামপন্থী। ফলে সে হত্যার টার্গেট ছিল আলেমগণও। তাই হত্যার শিকার হতে হয় প্রখ্যাত আলেম মোস্তাফা আল মাদানী সাহেবসহ বহু আলেমকে। হত্যার টার্গেট ছিল গ্রামের অরক্ষিত মাতবর -যারা সে সময় সংগঠিত করেছিল থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তিকমিটি। সে হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি আর যে কাজটি একাত্তরে করতে হতো তা হলো বোমা মেরে রেলের ব্রিজ, রেল লাইন ও বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার উড়িয়ে দেয়া। এটিই ছিল একাত্তরে ইসলামী চেতনাশূণ্য মুক্তিবাহিনীর সদস্যডদের পথ। এটি ছিল হারাম পথ। কোন ঈমানদার কখনোই এপথ বেছে নিতে পারেনি। একাজ একমাত্র শয়তানের পৌত্তলিক খলিফা তথা ভারতীয়দেরই খুশি করতে পারে, আল্লাহ তায়ালাকে নয়। এটি হলো জাহান্নামের পথ।
একাত্তরে দ্বিতীয় পথটি ছিল, পৌত্তলিক ভারতের হামলা থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় খাড়া হওয়ার পথ। এটিই ছিল রাজাকারদের পথ। ঈমানদারদের কাছে একাত্তরে এই একটি মাত্র পথ ছাড়া অন্য কোন পথ খোলাই ছিলনা। ফলে যারা প্রশ্ন করে, একাত্তরে ইসলামপন্থীরা কেন পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের সৃষ্টিকে সমর্থণ করলো না -তারা মূলত ইসলামের এ মৌল বিষয়ে জাহেল অর্থাৎ অজ্ঞ। কুর’আন হাদীসের সামান্য জ্ঞান থাকলে এরূপ প্রশ্ন তারা কখনোই করতো না। তবে একাত্তরে আরেকটি পথ খোলা ছিল, সেটি হলো নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকার পথ। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্র যখন ভারতের ন্যায় একটি কাফির শক্তির হামলার শিকার হয় তখন নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকাটি হারাম। সে মুহুর্তে নিষ্ক্রিয় থাকাটি নিতান্তই মুনাফিকির লক্ষণ। কোন ঈমানদার সে মুহুর্তে নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। এজন্যই একাত্তরে কোন আলেম, কোন মুফতি, কোন মাদ্রাসা ছাত্র এবং ইসলামপন্থী দলের কোন নেতা ও কর্মী পাকিস্তান ভাঙার পক্ষে দাঁড়ায়নি এবং মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়নি। একজন ঈমানদার যেমন মদ্য পান, জ্বিনা বা শুকরের গোশত খাওয়ার ন্যায় হারাম কর্ম করতে পারে না, তেমনি মুসলিম দেশ ভাঙার হারাম যুদ্ধেও যোগ দিতে পারে না।
হিন্দু ধর্মে দেশ ভাঙা হারাম নয়। ভারতে কত গণহত্যা ও কত অপরাধই না ঘটে। কিন্তু তারপরও ভারতীয় হিন্দুরা দেশ ভাঙ্গেনি। ভারতকে তারা অখণ্ড রেখেছে। ভারতের শক্তি তো তার একতাবদ্ধ বৃহৎ ভূগোল। ভারতীয়দের মাথা পিছু আয় কাতার বা কুয়েতের মাথাপিছু আয়ের ১০ ভাগের এক ভাগও নয়। কিন্তু এরপরও কাতার বা কুয়েতের চেয়ে ভারত শতগুণ শক্তিশালী। সে শক্তির কারণ, ভারতের বৃহৎ ভূগোল। একই কারণে রাশিয়া আজ বিশ্বশক্তি। অথচ রাশিয়ার অর্থনীতি দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতির চেয়েও দুর্বল। কিন্তু রাশিয়া তার বৃহৎ ভূগোলের জন্য বিশ্বমোড়ল।
আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডা এবং শয়তানের এজেন্ডা
মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বশক্তি রূপে দেখতে চান। সেজন্য তিনি একতাকে ফরজ ও বিভক্তিকে হারাম করেছেন। একতার সে পথ ধরেই বিশ্বশক্তির মর্যাদা পেয়েছিল গৌরব যুগের মুসলিমগণ। তাই একাত্তরের যারা অখণ্ড পাকিস্তানর পক্ষে খাড়া হয়েছিল তারা বস্তুত খাড়া হয়েছিল মহান আল্লাহ তায়ালার এজেন্ডার পক্ষে। অপর দিকে শয়তানের এজেন্ডা হলো মুসলিম রাষ্ট্রের বিভক্তি। মুসলিমদের পতনের শুরুতো তখন থেকেই যখন থেকে তারা একতার বদলে বিভক্তির পথ বেছে নিয়েছে। এবং একাত্তরে সে বিভক্তির পথটিই ছিল শেখ মুজিব ও জেনারেল জিয়ার পথ। সেটি ছিল শয়তানের এজেন্ডাকে বিজয়ী করার পথ। এজন্যই তারা একাত্তরে একাত্ম হতে পেরেছিল শয়তানের ভারতীয় পৌত্তলিক খলিফাদের সাথে হতে। মুজিব ও জিয়ার অনুসারীরা এবং ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা তাই পরস্পরে আদর্শিক কাজিন। তারা সবাই তাই ফেরি করে একাত্তরের হিন্দুত্ববাদী বয়ান।
তাই একাত্তরে যারা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি -এ উভয় দলের নেতাকর্মীগণ সব সময় একই ভাষায় গালি দেয়। একাত্তরে তাদের রাজনীতি যেমন হারাম পথে পরিচালিত হয়েছিল, এখনো সে হারাম পথেই চলছে। সেটি স্পষ্ট বুঝা যায়, তাদের মুখে শরিয়া’র স্পষ্ট বিরোধীতা শুনে। শরিষার দানা পরিমাণ ঈমান থাকলে কেউ কি শরিয়ার বিরোধীতা করতে পারে? ইসলাম ও মুমিনের ঈমান কি সে অধিকার দেয়? শরিয়া বিরোধীদের নিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজের রায় শুনিয়েছেন সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর আয়াতে। উক্ত তিনটি আয়াতে তিনি তাদেরকে কাফির, জালিম ও ফাসিক বলে আখ্যায়ীত করেছেন। তাই যারা শরিয়ার বিরোধীতা করে তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র নেতা ও কর্মী হতে পারে, কিন্তু কখনোই মুসলিম হতে পারেনা। কোন ঈমানদার ব্যক্তি তাদের সে নীতি কখনো সমর্থণ করতে পারে না। কারণ একমাত্র বেঈমানই তাদের বেঈমানীকে সমর্থণ করতে পারে; কোন ঈমানদার নয়।