সে আর হলো কই? নেট বন্ধ রাখলেও ফোন তো আর বন্ধ রাখা যায় না। কাজেই মাঝে
মাঝে নেটে বসতেই হয়। আজ সারাদিন কয়েকটা বিষয় এত পীড়া দিচ্ছে যে, খোলাশা
না করলেও নয়। গত দুদিন যাবৎ দেখছি, সুব্রতদার একটা কথার প্রতিক্রিয়ায়
সুমন ভাই ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন, সো. হা. গীয় প্রচারণা, গালিবীয় পাতিলভাঙা
ইত্যাদি। এ বিষয়ে আর কথা বলতেই ইচ্ছে হচ্ছিলো না, তবু বলতে হচ্ছে।
প্রথমত, সুব্রতদা কাজটা ঠিক করেন নি। কোনো আলোচনা / বাতচিত মনঃপূত না হলে
তাকে কূটতর্ক, কচকচি বলার প্রবণতা আছে তার। সেটা তিনি আমাকে বলতেই পারেন।
আমি ছোট মানুষ। আমি কিছু মনে করবো না। কিন্তু সুমন ভাইকে বলা কি ঠিক?
সুব্রতদা আমাকে একটু ভুলই বুঝেছেন, ভেবেছেন আমি তার সামনে ধ্বনিতত্ত্বের
ক্লাস নিচ্ছি। ফলে পাল্টা তিনি ছন্দের ক্লাস নিতে শুরু করলেন। আমি
স্বীকার করি, এ বাংলার জীবিত কবিদের মধ্যে সবচেয়ে ছন্দ- ও ব্যাকরণসচেতন
কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ। তার সঙ্গে আলাপ করাটা সৌভাগ্যেরই ব্যাপার।
মাঝে মাঝে দুএকটি ধমক আসলে তাকে আমি গানের গমক হিশেবেই জ্ঞান করি।
কিন্তু তাই বলে পয়ারের পাঠ! তিনি কেন ভুলে গেলেন, অ্যাকাডেমিক প্রয়োজনে
হলেও আমাকে রফা করে আসতে হয়েছে তথাকথিত খর্বছন্দ, দীর্ঘছন্দ, উনপয়ার,
ভঙ্গপয়ার, মহাপয়ার, দিগক্ষরা, ত্রয়োদশাক্ষরা, একাবলী ও তোটক, গজগতি ও
ভুজঙ্গপ্রয়াত ইত্যাদি ইত্যাদি। পয়ার বলতে আমরা কোনো মাত্রাগণনা রীতিকে
বুঝি না, বুঝি পর্বভাগ-পদ্ধতি। সেঝুরা কথাটার মধ্যেই সে ইঙ্গিত আছে।
কাজেই পয়ার অক্ষরবৃত্তেরই বিশেষ বিন্যাসমাত্র, সে অর্থে আলাদা কোনো ছন্দ
নয়। রবীন্দ্রনাথ যদিও অক্ষরবৃত্তকে আট মাত্রার চাল হিশেবেই ধরেছেন,
কিন্তু সেটা তার নিজের কবিতা সম্পর্কেই খাটে না। অক্ষরবৃত্তের বৈচিত্র্য
বোঝার জন্য ভারতচন্দ্রের কাব্যই যথেষ্ট।
খলিল মাহমুদ একটা ভালো কথা বলেছেন। তিনি যেটা বলেন নি, সেটা আমিই বলে
দিচ্ছি, পর্ব মেলাতে গিয়ে যারা শব্দকে ভাঙে, তারা আশলে কান ছেড়ে চোখ দিয়ে
কবিতা শোনে। পুরাকালে পর্বযতি অনুসারেই কবিরা অর্থ-ন্যাস করতেন। তাদের
রচনা তাই ছড়ার সখা হয়েই ছিলো। মাইকেল একে মুক্তি দিয়েছেন। একালে কবির
মর্ম থেকেই তা বিদূরিত। আর ছান্দসিকেরা কালের ভ্রমবশত পর্বযতি নিয়েই পড়ে
আছেন। নতুন কালের ছন্দ নিরূপিত হবে অর্থযতির সঙ্গে পর্বযতির আপসরফার মধ্য
দিয়ে। পর্বযতির সঙ্গে অর্থযতির আপসে নয়।
এবার আসি, সুমন রহমান প্রসঙ্গে। আপনার কথায় শোচনীয়ভাবে সঙ্গতির অভাব। একে
টুকু ভণ্ডামি বলে থাকলে, সেটা কড়ালাপ হয়েছে, অপলাপ হয় নি। আপনার
বক্তব্যের অসঙ্গতিগুলি এমন :
১. প্রথমে আপনি আমার বক্তব্যকে হিয়ারিং হ্যালুসিনেশন বলেছেন। এবং আমাকে
বিশ্রামে যেতে বলেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, আপনার জবানবন্দি অনুযায়ী, আমার
বক্তব্য হ্যালুসিনেশন ছিলো না। সুতরাং আপনি তখন মিথ্যা বলেছিলেন, ইজ্জৎ
বাঁচানোর জন্য।
২. 'পাবলিক স্ফিয়ার' কথাটা বেশ শোনা যায় আপনার মুখে। সন্দেহ হয় ও-কথাটার
মানে আপনি ভালো বোঝেন কিনা। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, আজিজে, নিভৃত আলাপ নয়,
সেটা 'কবিতাকথা'য় উদ্ধৃত হলে সমস্যা কি? আপনি তো সুব্রতর পারিবারিক জীবন
বা কর্মজীবন নিয়ে কথা বলেন নি, বলেছেন কবিতা নিয়ে। তাহলে ব্যাপারটা
দাঁড়ালো এই, সুব্রতর কবিতা আপনার কাছে প্রাইভেট স্ফেয়ারে একভাবে ধরা দেয়,
পাবলিক স্ফেয়ারে অন্যভাবে। এটা কি ভণ্ডামি নয়?
৩. কবিসভায় আপনি বলেছেন, আশির সচল কবিদের মধ্যে মাসুদ খান ও কাজল
শাহনেওয়াজ ছাড়া আর কাকে নিয়েইবা ইতিবাচক ভাবনা ভাবতে পারি! এর মানে
দুরকম। প্রথমত, অন্যদের ব্যাপারে ভাবনাটা সেক্ষেত্রে নেতিবাচক। অথবা,
অন্যদের মধ্যে যাদের ব্যাপারে ইতিবাচক ভাবা যায়, তার এখন অচল। তাহলে
সুব্রত সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী দাঁড়ালো? স্পষ্টতই নেতিবাচক,
কারণ তিনি অচল নন। অথচ মুজিব মেহদীকে আপনি বললেন, "এখন আমি যদি বলি
সুব্রত বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কবি (এবং তিনি তাইই) তাহলে আপনার আন্দাজ-
নির্ভর বক্তব্যের ভবিতব্য কী দাঁড়ায়?" ভণ্ডামিটা কোথায় ধরতে পারছেন কি?
পরিশেষে, আমি সকলের কাছে মাফও চাই, দোয়াও চাই। এই মে মাসে আর কথা নয়।
তর্কের দোকান বন্ধ। পুরোদস্তুর, ষোলো আনা শ্রমিক হতে চাই। শেষ করতে চাই
গৌড়জনের কাজ। সবাই ভালো থাকুন। সুখে থাকুন। লাকুম দিনুকুম ওয়াল ইয়াদিন।
ইতি
গালিব
এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি, বিতার্কিক গালিবের বাকভঙ্গির মধ্যে
মাঝেমধ্যে একটা শিক্ষক-শিক্ষক ভাবের চোরাগোপ্তা প্রকাশ থাকে, থাকে
অল্পস্বল্প উগ্রতাচূর্ণও, উগ্রভাবে না বললেও (গালিব এ মন্তব্যের ব্যাপারে
কিছু মনে না করলে খুশি হই। কারণ আপনি কীভাবে বলেন সেটার মূল্যায়ন আপনার
চেয়ে আপনার শ্রোতারাই ভালো করতে পারেন।)। সুতরাং ওই ভঙ্গিটাকে গুরুত্বের
সাথে গণনায় না-নিয়ে বিতর্কের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিলে আমাদের জন্য অনেক
ফলদায়ক হয়, হতে পারে।
আমি চাই, ছন্দ নিয়ে আলাপটা বরং জারি থাক। অন্য প্রসঙ্গটি, যেটি ইতোমধ্যে
তিক্ততায় পর্যবসিত, অবসিত হোক। এক্ষেত্রে আমার অবস্থা এখন অনেকটা সুমন
রহমানের 'লালাবাই' কবিতার জলঢোঁড়ার মতোই, হৈ হৈ হাঁসের ডামাডোলে যে খুব
আর্ত বোধ করছে।
আমিও কি শিক্ষকসুলভ আচরণ করে ফেলেছি কোথাও, জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে, যেজন্য
এমন সম্বোধন?
সুব্রতা,
আপনি কি শুধু গালিবের জন্য লিখতেন এই ফোরামে? তাহলে তাঁর একার কথায়
অভিমান করে আর ছন্দ নিয়ে এই আসরে না লেখার ঘোষণা দিয়ে কি অন্য সদস্যদের বঞ্চিত করার
কর্মসূচি নেয়া হয়ে গেল না? যদি তা না হয়, তাহলে এই সিদ্ধান্ত বদলানোর অনুরোধ
করছি।
সকল তর্কই বেশ উপভোগ্য হয়েছে। কিন্তু আক্রমণটা ব্যাক্তি পর্যায়ে না নেয়াই
ভালো। বিপত্তি সেখানেই।
তপন
বাগচী