লেখালেখি পরিমণ্ডলে নিজের পরিচয়ে আমি ‘কবিতাকর্মী’ শব্দটি ব্যবহার করেই স্বাচ্ছন্দ্য পাই। অন্যেরা বলবার সময় অবশ্য অনেকখানি বাড়িয়ে নিজদায়িত্বে ‘কবি’ সম্বোধন করে থাকেন। সংকোচ ছাড়ে না আমাকে। এটা নিছক বিনয় নয়, নিজের অক্ষমতাজনিত এ বাকোৎসার; যা পড়াশোনা ও জানাবোঝার খামতিজাত, আমি জানি। এরকম ভাটিরাজ্যে বাস করেও অন্যান্য গ্রন্থের পাশাপাশি এ যাবৎ তিন-তিনটা কাব্যগ্রন্থের (মমি উপত্যকা, ময়দানের হাওয়া, চিরপুষ্প একাকী ফুটেছে) মোড়কে নিজের নাম লিখিয়ে ফেলেছি! সাবাস মুজিব মেহদী! ওসবে অন্তর্ভুক্ত রচনারাজির প্রতিটিই কবিতা হয়েছে, এরকম দাবি আমি সজ্ঞানে-অজ্ঞানে কস্মিনকালেও করি নি, করবোও না কোনোদিন।
তো, এহেন লেখনযাত্রায় মাঝেসাঝেই কিছু রচনার মধ্যে কাব্যলক্ষণের অতিরিক্ত অন্য কোনো কোনো লক্ষণ মূর্ত হতে দেখেছি। কিন্তু অবজ্ঞা করতে পারি নি, ফলে একটা দায়ও অনুভব করেছি এদের প্রতি। সংগত কারণে 'উভলিঙ্গ রচনা' পরিচয়ে যথাসাধ্য এদের সৎকারও করেছি। দিনকে দিন এরকম সীমাতিক্রমী আরো আরো রচনার ভার যখন আমাকে ভাবাচ্ছিল, তখন ঐতিহ্য প্রকাশনীর আরিফুর রহমান নাইম সহাস্যে সেসবের ভার নিতে চাইলেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো খুশি হলাম আমি। আর খেটেখুঁটে এসব খড়বিচালি দিয়ে একটা দুর্গ গড়বার পরিকল্পনাও করে ফেললাম। কাছাকাছি সময়ে মাহবুব মোরশেদ তাঁর সাময়িকীতে তথ্যটা ফাঁসও করে দিলেন!
কিন্তু কীভাবে, কোন যুক্তিতে গড়ব এই দুর্গ? এসব ভাবতে ভাবতে 'দুচেয়ারি বারান্দা' নামে একটা নাতিদীর্ঘ ভূমিকাই লিখে ফেলতে হলো (সংযুক্তি দ্রষ্টব্য) কথিত দুর্গের জন্য। সাথে ৫৩টি রচনার একটি ভুক্তিক্রম (সংযুক্তি দ্রষ্টব্য) তৈরি করে প্রতিশ্রুত সময়েই প্রকাশকের হাতে ১১২ পৃষ্ঠা আয়তনের পাণ্ডুলিপিটি সঁপে দিয়ে এখন রীতিমতো বগল বাজাচ্ছি আমি। কেমন হবে খড়বিচালির দুর্গ, তা নিয়ে একটা উদ্বিগ্নতা যদিও কাজ করছে মনের মধ্যে, তবু একটা স্বস্তিও সম্ভবত জায়গা করে নিয়েছে পাশে। তা নইলে এরকম একটা কমপ্লিশন রিপোর্ট আমি লিখছি কী প্রকারে?
খড়বিচালির দুর্গের প্রথম ভুক্তি
বীথির সবুজ চুলে বনানীর গন্ধ লেগে থাকে
কালোবাজারির অর্থে নির্মিত হাইরাইজ ঘেঁষে আসা ফাটকা বাতাস যখন বীথিটার চুল নিয়ে খেলছিল, অদূরেই প্রান্তরে দাঁড়ানো একলাগাছের নিচে দেশলাইয়ে বিড়ি ধরাতে আমি প্রাণান্ত ছিলাম, কেউ না আবার কেউও সে আমার কখনোসখনো, সুন্দরী শত্রুকন্যা হলেও যেমন পক্ষে দাঁড়ায় এসে পাড়ার মাস্তান, তেমনি আমিও খানিক গিয়ে বাঁহাতে ঘাড় ধরে ফাটকাটারে বলি, দূর হ বিষণ্ন ঝড়, দূর হ রুগ্ণ অশনি, হঠাৎ সে আলোড়ন ওঠায় এক বনজুড়ে, উচ্চৈঃস্বরে হুংকার তুলে এক ছোটোখাটো বাকুল্লা ওঠায়, ঝরাপাতা স্বরূপে রূপিণী হয়ে পথে পড়ে থাকাদের একখানে জড়ো করে রুমালের আলো নিয়ে খেলে খেলে ভবনের ওইপারে হারায় প্রাঙ্গণ, চোখে লাগা ধুলো ঝেড়ে আবার যখন আমি আমার মতো ঠিক হয়ে উঠি, আয়েসে আরেকটা বিড়ির পাছায় দেই সুখটান, ততক্ষণে উড়ন্ত পত্রকুল ঘুরেফিরে ল্যান্ড করে এসে পথে পথে
আমি একাকী বীথির কাঁধে হাত রাখি, সবুজ চুলে ওর নাক ঠেসে স্বস্তি চিবাতে চিবাতে বলি, চুল বেঁধে রাখো না কেন গো মেয়ে, সে একটা ঢেউ খেলানো হাসি দিয়ে বলে, আমার তো চুল বাঁধার কোনো ক্লিপই নেই
বলি, নেবে
নিতে পারি, কিন্তু চুলে নিষ্ঠ ক্লিপ-টিপ কী করে লাগাতে হয়, সেটাও তো জানি না হে, বাপু
শক্ত করে ধরে তার হাত বলি, চল তবে আমিই খুঁজে এনে দিই মহাদিশে
প্রকাণ্ড আড়ালে ছিল ছোটো মুদিঘর, যেদিকে মিলিয়ে গেছে বেয়াড়া বাতাস, ওকেসহ বীরের মতো হেঁটে মাপমতো ক্লিপ কিনে কেশারণ্যে নিজহাতে পরাই বাসনা, সেটা ছিল একাগাছতলা, ফাটকা বেয়াড়া বাতাস পরে চোরাগোপ্তা হামলা করেও বীথির গোছানো চুলে বাড়াতে পারে নি কোনো ক্ষয়ক্ষতি
অতীব ঘনিষ্ঠ আজ আমরা এই চরাচরে, পরস্পরের ছায়াতলে বসে নিতিদিন বিড়ি ফুঁকি আর দোহে মিলে প্রেমকাব্য করি, ও-শুধু হাসে আর মিটিমিটি কথা বলে চোখ দিয়ে, যে হাসিতে প্রতিবার আমার পৃথিবী পুরো ভেসে যায় একটা মন কেমন করা বন্যায়, প্রেমের প্রতিভা ওড়ে সীমাহীন সৌরজগতে
খড়বিচালির দুর্গের শেষ ভুক্তি
প্রতিষ্ঠানের হিজড়াকরণ শৈলীর একটা সাধারণ ছবি আঁকা সম্ভব
প্রথমেই অপ্রত্যাশিত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আশ্রয়ে ডেকে নেয়, বাহবা দেয়, তারপর দিনক্ষণ দেখে বিশ্বাসযোগ্য কৌশলে বলে-কয়ে মানিয়ে তুলে যে মডেলটি অসুস্থ, তবে অসুস্থতা কোনো দোষ বা অযোগ্যতা নয়, বুঝিয়ে, আপনি আসুন, বলে, হাত ধরে নিয়ে শুশ্রূষার সর্বোচ্চ প্রযত্নে শুইয়ে দেয় প্রতীকী টেবিলে, মডেলের শিথান ও পৈথান সাজিয়ে তুলে রংচঙে পথ্যাদি ও দুর্লভৌষধে, তার কোনো চিন্তা নেই, আরোগ্য হবার সর্বোত্তম উপায় তার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছে, এটা বোঝানো সম্ভব হলে সে চমৎকৃত রোগযাপন করে স্বচ্ছন্দ-অভিব্যক্তিতে, তার ওপর পরীক্ষিত হয় চেতনানাশকের গুণাগুণ এবং মডেল ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না যে তীব্রতম তীক্ষ্ণতা মাখানো চাকুয়, সঙ্গোপনে কখন কেটে ফেলা হলো মহান সৃজনবীর্য, মানে স্বাধীনতা, সাহস, শৌর্য ইত্যাদি, শেষে মুখ থাকে না, চোখ থাকে না, হাত থাকে না