রাহমানবধকাব্য

37 views
Skip to first unread message

সোহেল হাসান গালিব

unread,
Nov 25, 2009, 1:02:39 AM11/25/09
to কবিতাকথা
এই শিরোনামের সঙ্গে মেঘনাদবধের কোনো সম্পর্ক নাই। শ্রেণিশত্রু খতম আর
কোরান খতম যেমন এক জিনিশ নয়, তেমনি এখানে বধ কোনোভাবেই কতল নয়। প্রস্থান
বা সমাপন অর্থকেই শিরোধার্য করা উচিত। আর মনে রাখা দরকার জঙ্গীযুগের
কাব্যালোচনা এমনই হবে :)

ধর্মতত্ত্বের পর্যালোচনা শেষ করা বলতে যেমন আমরা নিধর্মীকরণ বুঝি না,
বুঝি বিবিধ ধর্মভাব ও অধর্মভাবের মধ্যে ভারসাম্য, তেমনি পুরাকালের
পদ্যমীমাংসা বলতে আমরা খারিজ-দাখিলই শুধু বিবেচনায় না এনে কলাবোধের
বিবর্তনটাও বুঝে নিতে চাই।

তো, আসুন, রাহমানবধ-প্রয়াসে এবার হাতে তুলে নিই তাঁরই কবিতা-আয়ুধ।

Sohel Hasan Galib

unread,
Nov 25, 2009, 1:31:47 AM11/25/09
to কবিতাকথা
নির্জন দুর্গ থেকে বেরিয়ে

(এই অকিঞ্চিৎকর আলোচনার উপজীব্য দে'জ প্রকাশিত 'শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা')


দেখাটা দুধরণের হতে পারে : সবার মতো দেখা এবং ‘নতুন দেখা’র দেখা। শেষোক্ত দাবিটি কবির কাছে পাঠকের। কেননা কবি দ্রষ্টাও বটেন। দেখার এই দুটি ধরণ যে দুমেরুর সে কথাও বলা যাবে না হয়তো। যা কেবল নিজের জন্য, তা আর সকলের মতো হলো কি হলো না, সে খবরে কার কী-বা আসে যায়! কিন্তু যখন ‘অপরের জন্যও উপভোগ্য’---এই ভাবনাটা আসে, তখন তাকে একটু বিশেষ না হলেই নয়। না হলে যে সেই অপরই বলে বসবে, ‘এ আর কী!’

এইখানে একটা ছোট্ট চালাকি, যদি চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেয়া যায় একটা ক্যালাইডোস্কোপ, তবে কিন্তু চেনা জিনিশকেও অচেনা মনে হয়। আর সেই অচেনাকে চেনবার জন্য মৃদুতম হলেও একটু কাঁপন, চার-দেয়া জলের নিচে মাছের চনমনে ভাব, পাতার শব্দে বেজির চমকে তাকানো---পাঠকের মধ্যে আমরা কল্পনা করে নিতে পারি।

কবি শামসুর রাহমানের দেখাটা সত্যিই নির্বিশেষ এবং সবার মতো দেখা। ফলে তার কারুবাসনা যাই হোক না কেন, পাঠকের সামনে কারূদ্ভাবনার দায় মেটানোই কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, যতই না তিনি আরাগঁকে বলে পাঠান---‘তোমার কাছে কোনোদিন পরিণামহীন এই পংক্তিমালা জানি না পৌঁছবে কিনা’, যতই আর্তনাদ উঠুক তার---‘খনি-শ্রমিকের বাতির মতন স্বপ্ন আমাদের’।

দেখা প্রসঙ্গে এত কথা বলার কারণ, নাগরিক মধ্যবিত্ত, যাদের দেখা ভিন্ন কাজ নাই এবং যারা যেতে যেতে যায় না কোথাও, তাদেরই  গোষ্ঠগানের কবি শামসুর রাহমান।

ঘরে-বাইরের একটা টানাপড়েনের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিলো রাহমানের কবিতার তাঁত বোনা। ঘর ও বাইরেকে বিচ্ছিন্ন ভাবার ফলে জীবনই শুধু বিঘ্নিত হয় না, খণ্ডিত হয় মনের সহজ বিকাশও। ঘরকে বড় করে তোলার নিষ্ফল চেষ্টা চলতে থাকে ততদিন পর্যন্ত, বাইরেকে ঠেকিয়ে রাখার ভুলমন্ত্র জপা শেষ না হয় যতদিন। এই মন্ত্রের উচ্চারণই ছিলো ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’
---

যদিও আমার দরজার কোণে অনেক বেনামি / প্রেত ঠোঁট চাটে সন্ধ্যায়, তবু শান্ত রুপালি স্বর্গ-শিশিরে স্নান করি আমি।

কিংবা,

উঁচু মিনারের নির্জনতায় ম’জে / ভেবেছি সহজে বিশ্বের মহাগান
আমার প্রভাতে সন্ধ্যায় আর রাতে / ঝর্না-ধারায় আনবেই বরাভয়।


বা,

নির্জনতার কারাগারে সঁপে প্রাণ / আত্মদানের মহৎ দুর্গ গড়ি।

নির্জন দুর্গের ভেতরে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। কেমন সেই প্রস্তুতি? তারই ভাষায় শোনা যাক :

এ ঘরে কত রাত ভালেরি এসেছেন, / কখনো কালিদাস, বোদলেয়ার, রুমি। 
পেরিয়ে স্বপ্নের সুনীল সেতু আর / টানেল কুহকের কখনো আসো তুমি।


একথা সত্য, সেদিনের তরুণ কবিমাত্রেরই ফরাসি বা ইঙ্গ-মার্কিন কবিতা ছিলো হাতেখড়ি, অনুশীলনের। বোদলেয়ার তার ভুল ইন্টারপ্রিটেশনসহ কেবলই অন্ধকার আত্মার আরাধনা, কুৎসিতের কামনা, পাপের উপাসনা নিয়ে বাংলার কবিকূলে এসে ভিড়েছিলেন বলে মনে করা হলেও, এলিয়ট তার শূন্য খাঁ-খাঁ জমিজমা নিয়ে এলেও, তার ব্যাপকতা তেমন দেখি না রাহমানের কবিতায়।

যদিও দুর্গের ভেতর থেকেই টের পাচ্ছিলেন : সম্মুখে কাঁপে অমোঘ সর্বনাশ।/ দিনের ভস্ম পশ্চিমে হয় জড়ো, / অনেক দূরের আকাশের গাঢ় চোখে / রাত্রি পরায় অতল কাজল তার।

কিন্তু ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’র নিচে দাঁড়িয়ে বলছেন : আমি অভ্যাসবশতঃ / কেবলি আলোর কথা বলে ফেলি।... / ... তোমরা কি অন্ধকার-প্রিয়?/ চলি আমি, এই লন্ঠনের আলো যে চায় তাকেই পৌঁছে দিও।



দীর্ঘদিন ধরে অবিরল কবিতা লিখে যাবার সুবিধা ও বিপদ দুইই আছে। সুবিধা হলো নিজেকে বদলে ফেলার সুযোগ, সেই সঙ্গে চিন্তার ধারাবাহিক ইতিহাসটাকেও সংকেতায়িত করে রাখা। ব্যাপারটা বনের ভেতর অবিরাম হাঁটার মতো
---যত দৈর্ঘ্য বাড়ে ততদূর ছড়ায় সমাধিফলক। বিপদের দিকটা আর কিছুই নয়, সমস্ত কিছুকে কাব্য করে তোলার অসফল প্রচেষ্টা কখনোবা কবিত্বকেই টিটকারি করতে থাকে।

রাহমানের কবিতায় কবির ইতিহাসটা মোটামুটি এলেও কবিতার বাঁকবদল তেমনটা ঘটে নি। জীবনানন্দের প্রভাববলয়ে থেকেও চমকপ্রদ মাত্রাবৃত্ত চালে সুন্দর সূচনা হয়েছিল তার। কিন্তু গলদটাও রয়ে গেছে শুরুতেই। জীবন দাশের কবিতায় রাজনীতির যে মর্মগত অবস্থিতি, হৈচৈ-হীন, তার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নি সেকালের অনেক কবির পক্ষেই। সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা ভাবা যেতে পারে। রাজনীতিকে শোরগোলের বিষয় এবং তাকে শরীরী-কাঠামোয় উপলব্ধি করার বস্তু বানিয়েছে বাংলা কবিতা। রাহমান সেভাবেই দীক্ষিত হয়েছেন। বিবরণধর্মিতাই হয়েছে তার প্রধান আশ্রয়। অনর্গল বক্তৃতার মতো। পুনরাবৃত্তিই যেন একটা কৌশল। রাজনৈতিক কোনো প্রকল্পের মতো, জনতার কাছে ঘুরে ফিরে একই কথা বারবার বলা। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রচার-প্রপাগাণ্ডার সমান্তরালে বিচার করা যেতে পারে বিষয়টাকে। ষাটের দশকের উতরোল বাগ্মিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বহিঃস্থিত কবির পক্ষে মৃদুভাষী হওয়া প্রায় অসম্ভব, আবার মধ্যবিত্তের পক্ষে উঁচু স্বরগ্রামে কথা বলাও স্বভাববিরুদ্ধ। ফলে দৈনন্দিন জীবনের রূপকার হয়েও কথা বলেন তিনি অনুচ্চ স্বরে। এমনকি যুদ্ধের সময়ে লিখিত কবিতাতেও (স্মরণযোগ্য ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতা)।

কবিতায় পুনরুক্তি আসতে পারে দুভাবে। একই বিষয় বা ভাবের বিস্তার
---আরও আরও বস্তুচৈতন্যের উদ্ভাস ঘটিয়ে---যেমন, ‘যেতে নাহি দিব’। দ্বিতীয়ত, একটি বাক্য বা বাক্যাংশকে আলাদা আলাদা প্রসঙ্গে প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। টেকনিক হিশেবে কোনোটিই এখন আর আদর পাচ্ছে না কবির কাছে। পাবে যে সে সম্ভবনাও কম। যদিও শামসুর রাহমান বেশ সমাদর করেছেন দ্বিতীয় পদ্ধতিটির---স্বাধীনতা তুমি, তোমাকে পাওয়ার জন্যে, তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা, জীবন মানেই ইত্যাদি গানের ধুয়ার মতো ব্যবহার করেছেন। যদিও বাংলার চারণ কবিরা তার রাহবার নন, তাকে পথ দেখিয়েছে সমকালীন বিদেশি কবিতা।

মূলত সমকালীনতাই আরাধ্য তার। ক্ষণদর্শনের কবি তিনি
---এখানেই তার বিশিষ্টতা। দিনপঞ্জিকে অবলীলায় মহাকালের পঞ্জিকাস্তূপের দিকে ছুড়ে দেবার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। দাঁড় করিয়েছেন অনবদ্য কিছু পঙ্ক্তি, অভিনব উপমা ও রূপক---আমদানি ও উদ্ভাবনে মাখামাখি :

  • লিপস্টিক ঘ’ষে মুছে ফেলা ঠোঁটের মতন আত্মা নিয়ে
  • আত্মার পিছল বয়া চেপে
  • নীলের ফরাশে দ্যাখো বসেছে তারার মাইফেল
  • জকির শার্টের মতো ছিল দিন একদা আমারও
  • জ্বলে দূরে তারার সেনেট
  • মেঘের গোযোর নেই একটু আকাশে
  • তসবী-দানা চোখে নিয়ে চেয়ে আছো রোদের ভেতরে
  • গলিত কাচের মতো জলে
  • কেমন সবুজ হয়ে আছে ক্রিয়াপদগুলি
  • তেজপাতা-রঙ বুড়িটার ঘরে
  • স্বাভাবিকতার ভাস্বর রেহেল থেকে
  • হাড়ের ভেতরে সে ঘুমায় নিরিবিলি
  • চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়


এ তালিকা অনায়াসে আরও দীর্ঘ করা যেত নিশ্চয়ই। কিন্তু কবির ক্ষণদর্শনের মজ্জাগত বিষয় নিয়ে একটি কথা না বললে আলোচনা থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। রাহমানের প্রথম দিককার এবং মধ্যজীবনের রচনায় প্রতীচ্য পুরাণ বা মিথের ব্যবহার দেখি। লক্ষ করা যেতে পারে, সমকালীন চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পুরাণ ব্যাখ্যা বা বিনির্মাণের আগ্রহ তার ছিলো না। তিনি মিথকে টেনেছেন স্বদেশ ও স্বকালের কোনো ঘটনার সমান্তরালে, খানিকটা রূপকাভাস তৈরির কৌশলে। যেমন ‘টেলেমেকাস’, ‘স্যামসন’। ফলে তার এই কাব্য-অভিযানে কবির অভিনিবেশ ঘটেছে ঘটনার উপরিকাঠামোয়, অন্তর্গত গরমিলে কোনো আপসরফা হয় নি।

কেবল ঘটনা নয়, চেতনার নানারূপ সংঘাতের পূর্বাভাস ধরা পড়ে কবিতায়। রাহমানের কবিতা শোকাবহভাবে সংঘটিত বিষয়ের প্রতিক্রিয়ামাত্র, পূর্বাভাসশূন্য। যে ধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় শিক্ষিত সাধারণের ভেতরেও। ফলে কবির প্রতিক্রিয়া সহজপাঠ্য হয়ে ওঠে, এমনকি তাকে বলা যেতে পারে ঐ সাধারণেরই আবেগভাষ্য। কবির ভাষাটি তাই প্রতিদিনকার, বিবৃতি ও বিবরণধর্মী, কিন্তু নয় তা সাধারণের (ব্যতিক্রম : ‘এই মাতোয়ালা রাইত’)। সাধারণের হবার দরকারও নেই। কিন্তু ভাষার উৎকর্ষ যেখানে ঘটে, যেখানে শব্দ লুপ্ত হয়ে গিয়ে কেবলই ইশারা, অব্যক্তি আর নৈঃশব্দ্যে ছড়িয়ে পড়ে, ফুলের পাপড়ি খশে গিয়ে যেখানে জাগে শুধুই গন্ধ-বেদন, সেই অবস্তুবিশ্বের থেকে অনেক দূরে শেষ পর্যন্ত এক অতি-পরিচয়ের ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করে শামসুর রাহমানের কবিতা।


নভেম্বর ২০০০৯
উপান্ত, উত্তরা


Reply all
Reply to author
Forward
0 new messages