বাংলা ছন্দোচর্চার ধারা ও কবি উত্তম দাশের ছন্দোচিন্তা

2,195 views
Skip to first unread message

তপন বাগচী

unread,
Dec 3, 2009, 1:23:28 AM12/3/09
to কবিতাকথা, drbagch...@gmail.com
বাংলা ছন্দোচর্চার ধারা ও কবি উত্তম দাশের ছন্দোচিন্তা
তপন বাগচী

বাংলাদেশে ছন্দোচর্চার সূত্রপাত মধ্যযুগে। পিঙ্গলাচার্য নামের এক কবি
সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষার ছন্দ বিশ্লেষণ করে রচনা করেন ‘ছন্দঃসূত্র’। এর
অনেক পরে ছন্দোশাস্ত্রের গ্রন্থ রচনা করেন গঙ্গাদাস নামের এক লেখক। তাঁর
সেই গ্রন্থের নাম ‘ছন্দোমঞ্জরী’। গ্রন্থটি ষোড়শ শতকের শেষ পাদে
সংস্কৃতভাষায় রচিত হলেও এর লেখক ছিলেন বাঙালি। অষ্টাদশ শতকের শুরুতে
নরহরি চক্রবর্তী নামে আরেক বাঙালি লিখলেন ‘ছন্দ-সমুদ্র’। বিশ্লেষণের জন্য
তিনিও নির্বাচন করেন সংস্কৃত বা প্রাকৃত ভাষার ছন্দ। তবে অষ্টাদশ শতকের
শেষের দিকে হ্যালহেডের ব্যাকরণগ্রন্থে বাংলা কবিতার ছন্দ প্রকরণ নিয়ে
আলোচনা রয়েছে। ছান্দসিক উত্তম দাশের মতে, তা ছিল, ‘ইংরেজি পদ্ধতিতে বাংলা
ছন্দের ব্যাখ্যা’।
তবে বাংলা ছন্দের ব্যাখ্যয় যিনি প্রথম অবদান রেখেছেন তিনি পঞ্চদশ শতকের
বাঙালি কবি মালাধর বসু। ভাগবতের অনুবাদক হিসেবে তিনি বেশি খ্যাতিমান হলেও
ছন্দের পরিভাষা ‘পয়ার’-এর কথা তিনিই প্রথম উচ্চারণ করেন-
‘ভাগবত অর্থ যত পয়ারে বাঁধিয়া
লোক নিস্তারিতে করি পাঁচালি করিয়া॥’
এরপরে আরো অনেক কবি তাঁদের কবিতায় ছন্দের নানান পরিভাষার অবতারণা করেছেন।
তাঁদের মধ্যে মনসামঙ্গলের কবি কবি বিজয় গুপ্ত ও কবি নারায়ণ দেব,
‘চৈতন্যমঙ্গল’-এর কবি লোচন দাস উল্লেখযোগ্য। তবে, বাংলা ছন্দের স্বরূপ
উন্মোচনের কৃতিত্ব রাজা রামমোহন রায়ের। তাঁর ‘বেঙ্গলি গ্রামার ইন দি
ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ’ (১৮২৬) গ্রন্থে তিনি বাংলা ছন্দ নিয়ে প্রথম আলোচনা
করেন ইংরেজিতে। পরে তাই ভাষান্তরিত হয় ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণে’ (১৮৩৩)। ‘বাংলার
প্রথম ছান্দসিক’ হিসেবে রাজা রামমোহন রায়কে স্বীকৃতি দিয়েছেন
প্রবোধচন্দ্র সেন।
রামমোহন রায়ের পরে ছন্দোচর্চার কৃতিত্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। গবেষক
উত্তম দাশের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, ‘রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছন্দের বিভিন্ন
রীতির স্বরূপই মাত্র উদ্ঘাটন করেননি, বাংলা ছন্দের নানা রূপবিধির নিত্য
নতুন সম্ভবনার দরজাও উন্মুক্ত করেছেন এবং কাব্যসাধনার অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত
করেছেন ছন্দশাস্ত্রের আলোচনায়।’ রবীন্দ্রনাথের সমকালে ছন্দ নিয়ে আলোচনায়
ব্রতী হয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বিজয়চন্দ্র
মজুমদার, রাখালরাজ রায়, প্রবোধচন্দ্র সেন, অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়,
দিলীপকুমার রায় প্রমুখ। তবে রবীন্দ্রনাথের ‘ছন্দ’ (১৯৩৬) বাংলায়
ছন্দোশাস্ত্রের পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের মর্যাদা পাচ্ছে। এর বছর দুয়েক পরে
প্রবোধচন্দ্র সেন প্রকাশ করেন ‘বাংলা ছন্দে রবীন্দ্রনাথের দান’ (১৯৩৮)
গ্রন্থটি। এর পরে বাংলায় ছন্দের চর্চা যেন নতুন গতি লাভ করে। বিশ শতকের
প্রথমার্ধেই প্রকাশিত হয় অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলা ছন্দের
মূলসূত্র’ (১৯৩৯), দিলীপকুমার রায়ের ‘ছান্দসিকী’(১৯৪৫), প্রবোধচন্দ্র
সেনের ‘ছন্দোগুরু রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৪৫), মোহিতলাল মজুমদারের ‘বাংলা কবিতার
ছন্দ’ (১৯৪৫), তারাপদ ভট্টাচার্যের ‘ছন্দোবিজ্ঞান’ (১৯৪৮) নামের গ্রন্থ।
এরপরেও ছন্দোচর্চা ও ছন্দোবিশ্লেষণ চলেছে। এখনো এর গতি রুদ্ধ হয় নাই।
ছান্দসিক হিসেবে সব চেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন প্রবোধচন্দ্র সেন। তাঁর
‘ছন্দপরিক্রমা’ (১৯৬৫), ‘ছন্দজিজ্ঞাসা’ (১৯৭৪), ‘বাংলা ছন্দের
ক্রমবিকাশ’ (১৯৭৮), ‘বাংলা ছন্দশিল্প ও ছন্দচিন্তার অগ্রগতি’ (১৯৮৭) এবং
‘নূতন ছন্দ পরিক্রমা’ (১৯৮৬) তাঁর ছন্দেচিন্তার অক্ষয় স্মারক।
প্রবোধচন্দ্র সেনের পাশাপাশি সুধীভূষণ ভট্টাচার্য (‘বাংলা ছন্দ’: ১৯৬২),
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (‘ছন্দ সরস্বতী’, অলোক রায় সম্পাদিত: ১৯৬২), তারাপদ
ভট্টাচার্য (‘বাংলা ছন্দ-তত্ত্ব ও ছন্দ বিবর্তন’: ১৯৭১), শঙ্খ ঘোষ
(‘ছন্দের বারান্দা’: ১৯৭০), নীলরতন সেন (‘আধুনিক বাংলা ছন্দ -প্রথম
পর্ব’: ১৯৬৩, চর্যাগীতির ছন্দপরিচয়’: ১৯৭৪, ‘আধুনিক বাংলা ছন্দ’: ১৯৭৯,
‘বাংলা ছন্দ বিবর্তনের ধারা’: ১৯৮৩, ‘প্রসঙ্গ বাংলা ছন্দশিল্প’: ১৯৮৯),
‘আধুনিক বাংলা ছন্দ দ্বিতীয় পর্ব’: ১৯৭৯), নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
(‘কবিতার কাস: ১৯৭৭), রামবহাল তেওয়ারী (‘আধুনিক বাংলা ও হিন্দি ছন্দ’:
১৯৭৭), সুহৃদকুমার ভৌমিক (‘বাংলা ছন্দের বিবর্তন’: ১৯৭৮), আবদুল কাদির
(‘ছন্দ সমীণ’: ১৯৭৯), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (‘বাংলা কবিতার ছন্দ’:
১৯৭৯), দেবতোষ বসু (‘বাংলাছন্দের প্রগতি’: ১৯৮৫), আবদুল মান্নান সৈয়দ
(‘ছন্দ’: ১৯৮৫), শাহজাহান ঠাকুর (‘বাংলা ছন্দের রীতি রূপ ও বিকাশ’:
১৯৮৫), উত্তম দাশ (‘বাংলা ছন্দের কূটস্থান’: ১৯৮৫, ‘বাংলা ছন্দের
অন্তঃপ্রকৃতি’: ১৯৯২, ‘কবির ছন্দ কবিতার ছন্দ’: ২০০৭) প্রমুখ ছান্দসিক
বাংলা ছন্দোশাস্ত্রকে পূর্ণতাদানে ভূমিকা রাখে।
আমাদের ষাটের কবিদের মধ্যে কলকাতায় উত্তম দাশ আর ঢাকায় আবদুল মান্নান
সৈয়দ ছন্দোচর্চায় অনুকরণীয় অবদান রেখেছেন। লক্ষণীয় যে, দু’জনেই দুই দেশের
খ্যাতিমান কবি। দেশভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গে কবিদের মধ্যে যাঁরা ছন্দোচর্চা
করেছেন তাঁরা হলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ ও উত্তম দাশ। আর
বাংলাদেশে কবিদের মধ্যে যাঁরা ছন্দোচর্চা করেছেন তাঁদের মধ্যে
উল্লেখযোগ্য অবস্থানে রয়েছেন আবদুল কাদির, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও আবদুল
মান্নান সৈয়দ। এছাড়া সত্তরের কবি মুজিবুল হক কবীর ও নব্বইয়ের কবি হাসানআল
আবদুল্লাহ ছন্দ সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেছেন। আর যাঁরা ছন্দ সম্পর্কে
রচনা করেছে তাঁরা কেউ-ই কবি কিংবা ছান্দসিক নন। এঁদের প্রায় সকলেই
শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে অর্থাৎ উচ্চমাধ্যমিক-উত্তর প্রাতিষ্ঠানিক
পাঠচাহিদা পূরণের জন্য ছন্দোচর্চা করেছেন।
উত্তম দাশের ছন্দচর্চা কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। নিজে কবি বলে ছন্দের
দ্বারস্থ হয়েছেন। ষাটের দশকে প্রথমপাদে গদ্যকবিতার যতই জেয়ার বাসুক,
ছন্দের কাছে কবিদের যাতায়াত কমবেশি ছিলই। উত্তম দাশ কবিতা লেখার জন্য
ছন্দ আয়ত্ত করেছেন, আবার প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার প্রয়োজনে ছন্দ বোঝার
চেষ্টা করেছেন। সত্তরের শুরুতে তিনি যখন ‘বাংলাসাহিত্যে সনেট’ শিরোনামে
গবেষণা করতে যান, তখনই তাঁকে ছন্দ নিয়ে ভাবতে হয়েছে। হয়তো তখনকার
ছন্দোচিন্তার প্রকাশ ঘটে ‘বাংলা ছন্দের কূটস্থান’ নামের এক পুস্তিকায়।
তারই সম্প্রসারিত চিন্তার নবতর বিন্যাস ‘বাংলা ছন্দের অন্তঃপ্রকৃতি’
গ্রন্থ। এই গ্রন্থ পাঠ করে খ্যাতিমান অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন,
‘... বাংলা ছন্দের বিশেষজ্ঞজনের মধ্যে তোর স্থান অবধারিত হল। তুই শুধু
বিশ্লেষক নস্, বিচারকও।’ আমরা জানি যে, উত্তম দাশের আগেই বাংলা ছন্দের
ব্যাকরণ তথা বিশ্লেষণ নিয়ে যুগান্তকারী কাজ হয়েছে। ছন্দোশাস্ত্রকে বিশেষ
মহিমা দান করেছেন প্রবোধচন্দ্র সেন। সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে অন্য কারো
কথা বলা, নিতান্তই দুঃসাহস। কেবল বিশ্লেষকের যোগ্যতা নিয়ে অগ্রসর হওয়া
যাবে না। উত্তম দাশকে তাই বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে। উত্তম
দাশের কৃতিত্ব বোধ হয় এখানে যে, নতুন ব্যাকরণ নির্মাণ না করলেও প্রচলিত
ব্যাকরণকে পুনর্নিমাণ করেছেন।
বাংলা ছন্দের পরিভাষা নিয়ে অনুপুঙ্খ আলাচনায় ব্রতী হয়েছেন উত্তম দাশ।
ধ্বনি, বর্ণ, দল, কলা, মাত্রা, প্রস্বর, যতি-ছেদ, পর্ব, পর্বাঙ্গ, পদ,
পঙ্ক্তি, ছন্দসন্ধি, লয়, ছন্দোরীতি, মিশ্রবৃত্ত, কলাবৃত্ত, দলবৃত্ত,
গদ্যছন্দ, ছন্দের রীতিলঙ্ঘন, পয়ার প্রসঙ্গ, মধুসূদনের অমিত্রার_ এই সকল
পরিভাষার বিস্তৃত তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক আলোচনায় লেখক সিদ্ধরীতির বাইরে
এসে স্বকীয় চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। প্রবোধচন্দ্র সেন যেখানে
ছন্দোশাস্ত্রকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতি প্রতিষ্ঠা করেছেন, উত্তম দাশ সেখানে
বিজ্ঞানে সূত্রকে অমান্য না করেও কলা হিসেবে এর সম্ভাবনাকে প্রকাশ
করেছেন। উত্তম দাশের আলোচনার বৈশিষ্ট্য এই যে পূর্ববর্তী সকল অভিমত তিনি
পাঠ ও পর্যবেণ করেছেন এবং সেখান থেকে যুক্তিগ্রাহ্য গ্রহণ-বর্জনের মধ্য
দিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত প্রস্তুত করেছেন। নিজের মতকে তিনি চাপিয়ে দেয়ার
চেষ্টা করেননি।
সম্প্রতি এক কবির ছন্দো-বিশ্লেষণে আমি কিছু ত্রুটি আবিষ্কার করি। তিনি
এতে ক্ষুব্ধ হন। তিনি জানান যে, এগুলো সংস্কৃত ছন্দে লেখা বলে আমি ধরতে
পারিনি। কিন্তু আমার এই সামান্য অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, সংস্কৃত কিংবা
ইংরেজি ছন্দই হোক, যদি তা বাংলায় লেখা হয়, তবে ছন্দের ত্রিধারা দিয়ে তার
বিশ্লেষণ সম্ভবপর হয়ে ওঠে। অজ্ঞতা ঢাকার জন্য তখন এক-দুইমাত্রা বাড়ানো-
কমানোর জন্য সংস্কৃত ছন্দের দোহাই দিতে হয় না। এরকম পরিস্থিতিতে আমি
জবাব দিতে চাই, উত্তম দাশের রচনা থেকে উদ্ধৃতি প্রয়োগ করে। উত্তম দাশ
খুঁজে পেয়েছেন, ‘বাংলাভাষার উচ্চারণ দল বা সিলেবল-ভিত্তিক। সংস্কৃত-
প্রাকৃত ভাষার উচ্চারণ ধ্বনি-ভিত্তিক, অন্যপে ইংয়রেজি ভাষা প্রস্বর বা
অ্যাক্সেন্ট-নির্ভর।’ সংস্কৃত ভাষার ছন্দে বাংলা কবিতা লিখতে গেলে দু-
একমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে যেতে পারে। অবশ্য বড় কবি হলে তা সামলে নিতে
পারেন।
উত্তম দাশের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিজ্ঞানভিত্তিক। অর্থাৎ কোনো সিদ্ধান্ত
গ্রহণের আগে তিনি তা পরীক্ষা করেন, তারপর নিবিড় পর্যক্বেক্ষণ করেন, তারপর
সিদ্ধান্তে উপনীত হন। ধরা যাক ‘দল’ পরিভাষাটির আলোচনা। এই দলকে কে কী
নামে অভিহিত করেছেন, তা তিনি অনুপুঙ্খ আলোচনা করেছেন। আমরা একটা সারণি
আকারে তা দেখাতে চাই-

‘সিলেবল’-এর পারিভাষিক আখ্যা
রাজা রামমোহন রায় ধ্বন্যাঘাত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্রা
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মাত্রা
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত শব্দপাপড়ি
রাখালরাজ রায় স্বর
প্রবোধচন্দ্র সেন স্বর, ব্যষ্টি, দল
দিলীপকুমার রায় দল
অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় অক্ষর
মোহিতলাল মজুমদার অক্ষর
তারাপদ ভট্টাচার্য অক্ষর
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অক্ষর
উত্তম দাশ দল
সিলেবল-এর পরিভাষা কে কী মনে করেছেন, উত্তম দাশ তা নির্দেশ করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ কেন ‘অক্ষর’ মেনে নেননি, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রবোধচন্দ্র
কেন ‘দল’ সৃষ্টি করলেন, তারও ব্যাখ্যা দিলেন। তারপর নিজে তাকে ‘দল’ বলে
মেনে নিলেন। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবদুল
মান্নান সৈয়দ, কিংবা আবিদ আনোয়ারের মতো কবি-ছান্দসিক একে ‘অক্ষর’ বলেই
মেনে নিয়েছেন।
ছন্দোবিশ্লেষণে উত্তম দাশের উদারতা এই যে তিনি ‘বাংলা ছন্দের
রীতিলঙ্ঘন’কেও মেনে নিতে চাইছেন। সংজ্ঞার্থ হিসেবে তিনি বলেছেন,
‘ছন্দভেদে মুক্তরুদ্ধদলের রীতিনিষ্ঠ উচ্চারণ প্রকৃতির ব্যত্যয় ঘটলে তাকে
বলা হয় ছন্দের রীতিলঙ্ঘন’। এই সংজ্ঞার্থ মেনেও তিনি বলতে চান, ‘কিন্তু
ছন্দের রীতি লঙ্ঘনেও যে ছন্দপতন হয় না তার মূল কারণ নিহিত মুক্তরুদ্ধদলের
উচ্চারণ প্রকৃতির মধ্যে।’ এরপর তিনি রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব ও সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ছন্দের রীতিলঙ্ঘনকেও মেনে নেয়ার
সাহস দেখিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে উত্তম দাশের ধারণা, ‘বাংলাভাষায় একটা
নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে মুক্তরুদ্ধদলের প্রসারণ-সংকোচের সুযোগ নিয়ে কবিরা
বিশেষ অর্থবাচক ও অনুভূতি-প্রকাশক শব্দগুলিকে চি‎ি‎‎‎হ্ন‎ত করে দেন।
মুক্তদলের এই প্রসারণ-সংকোচনের মতা না থাকলে ছন্দে যে কোনো রীতিলঙ্ঘনই
হতো ছন্দপতন।’ এই উদারতার কারণেই উত্তম দাশের ছন্দেবিশ্লেষণ বিজ্ঞানের
কঠোর অনুশাসনের ভেতরেও কলা অর্থাৎ শিল্পের আনন্দ উপভোগ করা যায়।
একালের অনেক কবিই পয়ার চেনেন না। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় ও সত্যেন্দ্রনাথ
দত্ত পয়ারকে ছন্দোরীতি মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল, বুদ্ধদেব বসু
পয়ারকে ছন্দেরই একটি জাত মনে করতেন। প্রবোধচন্দ্র সেন পয়ারকে ছন্দরীতি
নাম নয়, ছন্দোবন্ধের নাম মনে করতেন। অনেকেই পয়ারকে কেবল অরবৃত্তের একটি
ধারা মনে করেন। কিন্তু যে কোনো ছন্দেই পয়ার রচিত হতে পারে। এ বিষয়ে
বিস্তর আলোচনা করেছেন উত্তম দাশ। তাঁর বেশিরভাগ অভিমতই প্রবোধচন্দ্রের
অভিমতের সদৃশ। তরপরেও তিনি নিজের মতো করে পয়ারের বৈশিষ্ট্য নির্ণয়
করেছেন--
‘পয়ারের যে বৈশিষ্ট্য বাংলাছন্দে গড়ে উঠেছে তাতে ছন্দের জাত হিসেবে
মেনে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। পরিভাষা হিসেবেও মিশ্রবৃত্তের পরিপূরক হিসাবে
পয়ারকে গ্রহণ করা শ্রেয়, কারণ দীর্ঘদিনের লোকসংস্কার এখঅনে ক্রিয়াশীল।
বাংলা কবিতার দীর্ঘদিন চোদ্দ মাত্রার পঙ্ক্তিবিন্যাস প্রচলিত ছিল, পরে যা
বর্ধিত হয়েছে আঠারো মাত্রার পঙ্ক্তিতে। কাব্যপঙ্ক্তির শুধু এই গঠন দেখে
পয়ারকে ছন্দোবদ্ধ বলার পেছনে যুক্তি নেই। এ কারণে যে অন্য ছন্দে বিভক্ত
সেখানে অর্ধযতিতে পদবিভাগ ছন্দোর মূল বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক নয়। পর্বই সেখানে
মূল ছন্দ নিয়ন্ত্রক এবং পর্বের গঠনের ওপরেই সেখানে ঐ দুই ছন্দের মূল
প্রকৃতি নির্ভরশীল।’ (বাংলা ছন্দের অন্তঃপ্রকৃতি, পৃ. ৮৫)
বাংলা ছন্দের কূটস্থান নির্ণয়েও তিনি ব্রতী হয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘বাংলা
ছন্দের কূটস্থান যতি’। পরণেই তিনি বলেছেন, ‘এই কূটস্থান কবির
সিদ্ধিস্থানও বটে।’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। এই প্রবন্ধে আমরা উত্তম
দাশের এরকম আরো কিছু চিন্তার বিচ্ছুরণ দেখি_
১. বাংলা ছন্দের নিজস্ব রূপ স্ফুট হয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দীতে, পরবর্তী
চারশো বছরে পয়ার রূপে মিশ্রবৃত্তই বাংলা কবিতার প্রধান বাহন। (পৃ. ১০৪)
২. নিয়ম ভেঙে যতি আসছে এমন জায়গায় যা উচ্চারণ-সম্মত অথচ
ছন্দবিরুদ্ধ। এই বিরুদ্ধতাকেই স্ববশে এনেছে যতি। (পৃ. ১০৫)
৩. মিশ্রবৃত্তের নিয়মে যতি থাকার কথা নয়। কিন্তু মধুসূদন আমাদের যতি
সম্পর্কিত ধ্যান ধারণার মূলে আঘাত করলেন, করতে চাইলেন। বাঙালির শিথিলবদ্ধ
উচ্চারণে গতি ও তেজ সঞ্চার করলেন, প্রস্বরহীন মিশ্রবৃত্ত ছন্দেই। (পৃ.
১০৫)
৪. মিশ্রবৃত্তের সাধুভাষাতেই তিনি (ভারতচন্দ্র) যে কাণ্ড করলেন, তার
জন্য বাঙালি পাঠক তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন এ কারণে যে তিনি স্বভাবিক
উচ্চারণের পথে বাঙালি কবিতাকে চালিত করতে চেয়েছেন। (পৃ. ১০৬)
৫. ছ’মাত্রার পর্ববিন্যাসে সম অসম মাত্রার বিচিত্র সমন্বয়ের সঙ্গে
দুটি সম বা অসম মাত্রার উপপর্ব মিলিয়ে যতিকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা
যেতে পারে। (পৃ. ১০৯)
৬. বাংলা কবিতার যতির প্রয়োগ স্বাভাবিক উচ্চারণের পথে, যার পরিণতি
বাক্ছন্দে। (পৃ. ১০৯)
এরকম আরো কিছু উক্তি উদ্ধার করায়, যা উত্তম দাশের ছন্দেচিন্তার নিজস্ব
প্রকাশ। আবার আমরা এ-ও ল করি যে, উত্তম দাশ ছন্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেনের
মতের প্রতিবাদ করতেও কুণ্ঠিত হন না। (পৃ. ১১১) চিন্তার মৌলিকতা না থাকলে
প্রবোধচন্দ্রের মন্তব্যে বিরোধিতা করা সম্ভবপর নয়।
কবিতার মিল নিয়েও চমৎকার আলোচনা করেছেন উত্তম দাশ। মিল যে ছন্দ নয়, সেকথা
নতুন করে বলার দরকার নেই। একবিংশ শতাব্দীতে এসে কোনো কেনো কবির ভাবনায়
মিল আর ছন্দ সমার্থক দেখে হতাশ হই। সেই সকল কবির (কিংবা অকবি) জন্য
‘মিলের কবিতা ও কবিতার মিল’ প্রবন্ধটি খুবই দরকারি। আমাদের জন্য আনন্দের
এই জন্য যে, কবিতায় মিলের গুরুত্বকে তিনি প্রকাশ করেছেন। আধুনিক কবিতায়
ছন্দ যেখানে অনিবার্য শর্ত নয়, মিল সেখানে গুরুত্ব না-পাওয়ারই কথা।
কিন্তু উত্তম দাশ বলতে চেয়েছেন, মিলের ধ্বনিগত সুষমা আমাদের টেনে নিয়ে
যায় কবিতার অভ্যন্তরে আরো কত কি রহস্য আছে সেখানে, সেই অন্বেষণে। কবিতার
কাছে জীবনের অনেক চাওয়ার কিছু প্রাপ্তি অন্তত মেলে, এইসব অভাবিতপূর্ব
মিলের পরিচয়ে।’ (পৃ. ১৩২)
আমরা কবি উত্তম দাশকে দেখি বাংলা ছন্দের নিজস্ব অর্জন অনুসন্ধান করতে।
তাঁর অনুসন্ধান ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে নেয়া যায়-
১. ‘চর্যাপদে’ যেমন সংস্কৃত-প্রাকৃতের খোলস ছেড়ে বাংলা ছন্দ নিজস্ব
রূপ পরিগ্রহ করতে শুরু করেছিল, যে রূপনির্মাণ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ আরো
সুগঠিত কিন্তু পূর্ণায়ত নয়।
২. পঞ্চদশ শতাব্দীর দুই প্রধান বাঙালি কবি কৃত্তিবাস ও মালাধর বসুর
রচনায় পয়ারের চেহারা নির্দিষ্ট আকার নিতে শুরু করলেও মাত্রাবিন্যাস সে
সময়েও সুস্থির নয়।
৩. কাহিনীকাব্যের উপযোগী একটা ভাষা ও ছন্দরীতি তিনি (কবি মুকুন্দ
চক্রবর্তী) নির্মাণ করে নিয়েছিলেন।
৪. মিশ্রবৃত্তে রীতিনিষ্ঠ গঠনগতরূ নির্মাণে এই ছন্দের সম্ভাবনাময়
রূপের কথাও ভেবেছিলেন কবিরা, যার প্রথম প্রত্য প্রকাশ ঘটল মধুসূদনে,
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথে এই ছন্দের আরো বৈচিত্র্য প্রকাশিত হতে দেখাব
আমরা।
৫. বাংলঅ ছন্দের বিশেষ করে মিশ্রবৃত্তের রীতিনিষ্ঠ রূপ গৃহীত হলো
অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্র রায়ের (১৭১২-১৭৬০) কবিতায়।
৬. দলবৃত্তের অন্তর্নিহিত রূপটি অবশ্য আবি®কৃত হয়েছে তাঁরই
(ভারতচন্দ্র) সমকালীন কবি রামপ্রসাদ সেনের (১৭২৩-৭৫) কবিতায়।
৭. হস্ধ্বনির ধ্বনিসংকোচে এবং প্রতিপর্বের শুরুতে প্রস্বর ব্যবহারে
বাংলঅ ছন্দের একটি লৌকিক চটকদার রূপ ঈশ্বরচন্দ্র আবিষ্কার করেছেন।
৮. পঙ্ক্তির মাপ বজায় রেখে ভাবপ্রবাহকে পঙ্ক্তি বন্ধন থেকে মুক্তি
দিয়ে মধুসূদন বাংলা ছন্দকে প্রথম বন্ধনের মধ্যে মুক্তির স্বাদ এনে দিলেন।
৯. বাংলা ছন্দে রবীন্দ্রনাথ এমন এক ব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলা ছন্দকে
পৌঁছে দিয়েছেন রীতিনিষ্ঠ গঠনরীতির চূড়ান্ত সীমায়, আবার তিনিই ছন্দের
পরিকাঠামো বিপর্যস্ত না করে বাংলা তিন ধারায় ছন্দের অনন্ত সম্ভাবনার
দরজাও খুলে দিলেন। বাংলা গদ্যছন্দের প্রবর্তক তিনি, ঐতিহাসিকভাবে এর কিছু
পূর্বসূত্র থাকলেও এই ছন্দের রীতিনিষ্ঠ গঠনগতরূপের স্রষ্টা তিনিই।
এরকম আরো অনেক অর্জনের কথা বলেছেন ছান্দসিক উত্তম দাশ। আমরা ল করি যে
তিনি ছন্দোচিন্তার েেত্র পূর্বমতকে যেমন গ্রহণ করেছেন, তেমনি আবার কোনো
কোনো েেত্র বর্জনও করেছেন। এভাবে গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে তিনি নিজের
মতপ্রতিষ্ঠায় অগ্রণী হয়েছেন। পাঠকের ছন্দোচর্চার সুবিধার কথা ভেবে তিনি
বিভিন্ন ছন্দে লেখা বেশ কিছু কবিতার ছন্দলিপিও প্রস্তত করে দিয়েছেন।
এগুলো সবই উত্তম দাশের তাত্ত্বিক আলোচনার অনুষঙ্গী বিষয়। তিনি ব্যবহারিক
আলোচনা করেছেন ‘কবিতার ছন্দ, কবির ছন্দ’ (২০০৭) গ্রন্থে। এই গ্রন্থের
উত্তম দাশের ছন্দোচিন্তা প্রতিভাত।
প্রথমেই তিনি সন্ধান করেছেন প্রবোধচন্দ্র সেনের ছন্দ-ভাবনা। প্রবোধচন্দ্র
কবি না হয়েও এবং বাংলা সাহিত্য্যের অধ্যাপক না হয়েও ছন্দোশাস্ত্র নির্মাণ
করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যে কী উপকার করে গেছেন, কোনো পুরস্কারেই তার
মূল্য শোধ হওয়ার নয়। শতাধিক প্রবন্ধ এবং ১১টি গ্রন্থ তাঁর ছন্দোচর্চার
স্মারক। ছন্দোশাস্ত্রে প্রবোধচন্দ্রের দানকে পাঁচপর্বে বিভক্ত করে নিয়ে
উত্তম দাশ যেমন মূল্যায়ন করেছেন, তা এরকম-
১. প্রথম পর্বে (১৯২২-২৩) ছন্দের বৈজ্ঞানিক নামকরণের কথা
ভেবেছেন।... তিনি বাংলা তিনজাতের ছন্দের নাম দিলেন অক্ষরবৃত্ত,
মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত।
২. ছন্দোচিন্তার দ্বিতীয় পর্বে (১৯৩০-৩৭) প্রবোধচন্দের প্রধান
আবিষ্কার দুটি: অক্ষরবৃত্ত হলো মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তের মিম্রণজাত
যৌগিকছন্দ এবং অরবৃতেদ্তর পূর্ণপর্বের গঠন চার মাত্রার।
৩. প্রবোধচন্দ্রের তৃতীয় পর্বের (১৯৪১-৪৭) ছন্দোচিন্তায় যতির ধারণা
আরো পরিণত হলো।
৪. ছন্দচর্চার চতুর্থ পর্বে (১৯৫৭-৬৫) তৃতীয়বারের মতো ছন্দোনামের
পরিবর্তন করলেন প্রবোধচন্দ্র। তাঁর এ পর্বের মিশ্রবৃত্ত, দলবৃত্ত,
কলাবৃত্ত নাম অনেক যুক্তিসঙ্গত ও বৈজ্ঞানিক কিন্তু একেবারে বিতর্কহীন নয়।
৫. ছন্দচর্চার পঞ্চম পর্বে (১৯৬৫-৮৬) প্রবোধচন্দ্রের পঁয়ষট্টি বছর
ধরে ছন্দচর্চার পরিণতি ঘটল। ছন্দের বিভিন্ন পরিভাষা বিচার বিশ্লেষণ করে
একটা বিজ্ঞানসম্মত রূপ দিলেন তিনি।
প্রবোধচন্দ্রের ছন্দোচর্চা সম্পর্কে মূল্যায়নের অধিকার রয়েছে উত্তম দাশের
মতো ছান্দসিকেরই। সেই অধিকার তিনি প্রয়োগ করেছেন অন্তরিক নিষ্ঠায়। কেবল
প্রবোধচন্দ্র নন, অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের ছন্দোচিন্তাও মূল্যায়িত হয়েছে
উত্তম দাশের কলমে। অমূল্যধনও বাংলা ভাষার অধ্যাপক ছিলেন না। কলেজ ও
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াতেন। বাংলা ছন্দোশাস্ত্রে তাঁর অগাধ
পাণ্ডিত্যের কথা আমরা সকলেই জানি। অমূল্যধনের চিন্তা থেকে এই শাস্ত্র আরো
অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু তাঁর অবদানকে খাট করে দেখার সুযোগ নেই। সেই বিচেনা
থেকেই উত্তম দাশের মূল্যায়নÑ
‘অমূল্যধন নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলা ছন্দের একটা বিধিবদ্ধ
ব্যাকরণ রচনা করতে গিয়ে একটা নতুন ছন্দতত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন।
পরবর্তীকালে তা সম্পূর্ণ গ্রহীত না হলেও বাংলা ছন্দশাস্ত্রের সূচনাকারী
হিসাবে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণীয়।’
উত্তম দাশের অসাধারণ পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া গেছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের
ছন্দবিচারের ক্ষেত্রে। ‘ছন্দোবন্ধনে অধরামাধুরী’ নামের এই প্রবন্ধে তিনি
রবীন্দ্রনাথের সকল গানের ছন্দ নির্ণয় করে সারণি প্রস্তুত করেছেন। এই
ধরনের শ্রমসাধ্য কাজ সম্পন্ন করার মতো যোগ্য মানুষ দুই বাংলায় তুলনারহিত।
রবীন্দ্রনাথের ২১৭৪টি গানের মধ্যে মিশ্রবৃত্ত ছন্দে ২৮৫টি, কলাবৃত্তে
৮৩২টি, প্রতœকলাবৃত্তে ৪০টি, দলবৃত্তে ৯৮৮টি, গদ্যছন্দে ২১টি, সংস্কৃত
ছন্দে ৮টিগান রচিত। এই যে পরিসংখ্যান উত্তম দাশ তৈরি করেছেন, তা
রবীন্দ্রনাথের গানের সুর-প্রবণতাকে সনাক্ত করতে সহজ করে দিয়েছে। আর কেবল
সারণি প্রস্তুত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, কোন্ বয়সে কোন্ ছন্দের প্রতি
আকৃষ্ট হয়েছেন বেশি, তাও তিনি নির্ণয় করেছেন। বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গিগত
নতুনত্বে এই প্রবন্ধটি বাংলা ছন্দোশাস্ত্রে একটি সেরা প্রবন্ধের মর্যাদা
পাবে।
উত্তম দাশ কেবল রবীন্দ্রনাথের কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ নয়; এই গ্রন্থে
জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং শক্তি
চট্টেপাধ্যায়ের কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ করেছেন। এই চার কবির ছন্দ সম্পর্কে
তাঁর গভীর পর্যবেণ হলো-
১. ‘শতশত শত জলঝর্নার ধ্বনি’র শুশ্রƒষার সংকেতে জীবনানন্দ তাঁর
কবিতায় আমাদের পীড়িত আত্মার জন্য দিয়ে গেলেন মিশ্রবৃত্ত ছন্দের এক
ব্যক্তিত্ববান উচ্চারণে। তখন নিশ্চিতই এই ছন্দ-বিদ্যুতের স্পর্শেই আমরা
উপনীত হই তাঁর বোধের জগতে।
২. প্রধানত মিশ্রবৃত্ত ও কলাবৃত্তকে যে কোনো ভাবনা প্রকাশে অনুগামী
করে বিপুল শক্তির অধিকারী করে তুলেছেন। বাংলা ছন্দে এই শক্তি সঞ্চয়েই
সুধীন্দ্রনাথের অনন্যতা।
৩. কথ্য বাগ্ভঙ্গিতে বাংলা ভাষাছাঁদকে পালটে দিয়ে লাগাম হাতে তিনি
শাসন করেছেন বাংলাছন্দের বিশাল সাম্রাজ্য। চলতি বাগধারায় আপন ভাবনালেঅককে
যুক্ত করেছেনর অওজ্ঞানের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে।. . . বাংলা কবিতা ও ছন্দের
জগতে এখানেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্বাতন্ত্র্য, তাঁর অনন্যতা।
৪. তাঁর (শক্তি চট্টোপাধ্যায়) কবিজীবনের বিচিত্র ও বহুমুখী অভিজ্ঞতা
এবং অনুভবকে তিনি কবিতার রহস্যভূমিতে স্থাপন করেছেন নিজস্ব কবিভাষা ও
ছন্দপ্রকরণে। তাঁর কাব্য সাধনায় বাংলা কবিতা ছন্দের তত্ত্বজাল ছিঁড়ে
যথার্থই ছন্দের অনন্ত সম্ভাবনায় মুক্তি পেয়েছে।
উত্তম দাশের ছন্দোচিন্তার প্রকাশ কেবল এই দুই গ্রন্থেই সীমাবদ্ধ নয়।
বুদ্ধদেব বসুর কবিতার ছন্দ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে তাঁর। এছাড়া বাংলা
কাব্যনাট্যের আলোচনা কিংবা কবিতা সম্পর্কিত বিচ্ছিন্ন আলোচনায় তিনি
ছন্দের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন। উত্তম দাশ কেবল ষাটের দশকের অন্যতম কবি
নন, তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ ছান্দসিকও বটে। প্রবোধচন্দ্র তাঁকে উদ্দেশ্য কর
বলেছিলেন, ‘আমি বাংল ছন্দের নীরব ব্যাকরণ-জিজ্ঞাসু, আর তুমি বাংলা ছন্দ-
রসের দিশারী।’ আমরা এই মত মেনে নিতে আপত্তি করছি না। বাংলা ছন্দ ধারায়
উত্তম দাশ একই সঙ্গে মৌলিক জিজ্ঞাসু এবং রসজ্ঞ বিশ্লেষক।
. . . . . . . . . . . . . . . .

Goutam Roy

unread,
Dec 3, 2009, 3:08:19 AM12/3/09
to kobit...@googlegroups.com
এসব বিষয়ে নতুন কিছু বলা বা মন্তব্য করার সামর্থ্য নেই, তবে লেখাটা পড়ে অনেক কিছু
জানতে পারলাম। ধন্যবাদ, তপন দা। :)

একটা অনুরোধ কি রাখতে পারি? কবিতাকথা হোক বা অন্য কোথাও হোক, কবিতা বা ছড়া
বিষয়ে সব আলোচনা শুধু বড়দের জন্য এবং বড়দের নিয়ে হয়। শিশু-কিশোরদের উপযোগী কোনো
আলোচনা (যেগুলো পড়তে তারা আনন্দ পাবে, কিছু শিখতে পারবে— এমনকি সেগুলো থেকে
বড়রাও উপকৃত হবে) চোখে পড়ে না। এদিকটায় কি মনোযাগ দিতে পারেন একটু? বড়রা
ছোটখাটো শব্দ নিয়ে মারামরি করতে করতে যেখানে অনেকটা সময় পার করে দেয়, সেই
সময়টায় ছোটরা অনেককিছু শিখে ফেলতে পারে, নিজেদের বোধটাকে শাণিত করতে পারে।
বড়দের বাদ দিয়ে ছোটদের দিকে নজর দিলে বোধহয় আখেরেই লাভ হবে। তপনদার কী মত এ
ব্যাপারে? ধন্যবাদ।

গৌতম


--
Goutam Roy
Research Associate
Educational Research Unit
Research and Evaluation Division
BRAC
75 Mohakhali, Dhaka 1212.

Phone: +88-02-9881265 Ext. 2707
+88-01712-018951

Web site: www.brac.net/research, www.bdeduarticle.com


--
This message has been scanned for viruses and
dangerous content by OpenProtect(http://www.openprotect.com), and is
believed to be clean -ITCELL

goutam_r.vcf

Tapan Bagchi

unread,
Dec 3, 2009, 4:12:21 AM12/3/09
to kobit...@googlegroups.com
গৌতম রায়,
আপনার পরামর্শে জন্য ধন্যবাদ।
‌'সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে
সহজ কথা যায় না বলা সহজে!'
বাংলঅ একাডেমীর 'ধান শালিকের দেশ' পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মাহবুব আজাদ আমাকে ছোটদের জন্য ছন্দ নিয়ে লেখার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন ধারাবাহিক প্রকাশ করবে বলে। কিন্তু ২ বছর পেরিরেয় গেছে। তাঁর অনুরোধ রাখিনি বলে, এখন কথা বলাবলিই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
শাহবাগ-এর  'বাংলার মুখ'-ও একই প্রস্তাব দিয়েছেন বই প্রকাশ বলে। কিন্তু কারো কথাই রাখতে পারিনি। নীরেন্দ্রনাথের ‌'কবিতার ক্লাস' কিবং সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের '‌ছড়ার ইসকুল'এর চেয়ে যদি আলাদা কিছু না লিখতে পারি, তবে না-লেখাই ভালো। সে জন্যই অপেক্ষা করছি। পড়ালেখা করছি। চিন্তাভাবনা করছি। যোগ্যতা অর্জন করছি। একটা পর্যায়ে পৌঁছলে নিজের  ভেতরে তাগিদ বোধ করব। তখন আর ঠেকায় কে?
তপন বাগচী

Goutam Roy

unread,
Dec 3, 2009, 4:19:01 AM12/3/09
to kobit...@googlegroups.com
তাহলে তো আপনার সাথে আমারও কথা বলা বন্ধ করতে হয়! ;)

সেদিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন আপনাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। আশা, খুব দ্রুতই দিনটি আসবে।

গৌতম

Tapan Bagchi wrote:
--
This message has been scanned for viruses and
dangerous content by OpenProtect, and is
believed to be clean -ITCELL

-- 
Goutam Roy
Research Associate
Educational Research Unit
Research and Evaluation Division
BRAC
75 Mohakhali, Dhaka 1212.

Phone: +88-02-9881265 Ext. 2707
+88-01712-018951

Web site: www.brac.net/research, www.bdeduarticle.com

--
This message has been scanned for viruses and
dangerous content by OpenProtect, and is
goutam_r.vcf

Tapan Bagchi

unread,
Dec 3, 2009, 4:30:02 AM12/3/09
to kobit...@googlegroups.com
গৌতম, ঠিক বলেছেন। কথা বন্ধ রাখতে হয়। কথা বন্ধ রেখে লেখাই তো চালাচ্ছি।
গত বছর একটি দৈনিকে ‌লেখালেখির ব্যাকরণ' নামে একটি ধারাবাহিক রাচনা প্রকাশিত হয়েছে ছোটদের পাতায়। আমি নিয়মিত ওই কলামটি পড়ি। দেখতে পাই, বেশ কিছু ভুলের অবতারণা। আমি লেখকের অফিসে গিয়ে নিরিবিলি পেয়ে তাঁকে ওই ভুলগুলোর কথা বলি। তিনি আমাকে ধন্যবাদ জানান এবং বই বের করার সময়ে খেয়াল রাখবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। ফেবরুয়ারিতে বই বেরুল। দেখি ভূমিকায় লিখেছেন, এক তরুণ পণ্ডিত তাকে পরামর্শ দিতে গিয়েছিল, কিন্ত সেটি তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি বলে আর বদলাননি। ভুলগুলো কিন্তু রয়েই গেছে। সেদিন এক তরুণ কবি ভুমিকায় উল্লিখিত ‌'তরুণ পণ্ডিতের' নাম জানতেদ চাইলে তিনি বলেন, ‌আরে ভুল তো আমি ইচ্ছা করেই রেখেছি। দেখি কেউ ধরতে পারে  কিনা। আর তরুণরা যদি এইটুকু ভুল করতেও শেখে বাকিটুকু তো ঠিক করবে'। তিনি অবশ্য আমার নাম আর বলেননি। গল্পটি আবার আমার কাছে ফিরে এসছে। খুব মজা পেয়েছি। ছন্দ নিয়ে যারা আলোচনা করছি, তারাই তো এখনো শুদ্ধ হতে পারিনি। বই লেখার জন্য আরো প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপনার পরামর্শ আমার প্রেরণা!!!
তপন বাগচী

moshiur khan

unread,
Dec 3, 2009, 5:26:04 AM12/3/09
to kobit...@googlegroups.com
 
ভালো লাগছে, কবিতাকথায় আবারও প্রাণের সঞ্চার হলো বোধ হয়।
সকলেই যদি নিজের বিবেচনায় যথার্থ কথাটি বলি আর অন্যের চিন্তাশীল কথাটি শুনতে
সহৃদয় আগ্রহবোধ ধরে রাখি, আমার ধারনা এই গ্রুপ সম্পর্কে বন্ধুরা গায়ে পড়ে
ঝগড়ার অভিযোগ আনা থেকে বিরত থাকবে। সকলের জন্য শুভ কামনা।

 

Tapan Bagchi

unread,
Dec 3, 2009, 2:42:23 PM12/3/09
to kobit...@googlegroups.com
িঠক কথা। কিন্তু  চুলোচুলিতে যে আমরা অনেকেই মজা পাই..! এই রোগ যে মজ্জাগত! তাই মাঝেমাঝে মেনে না নেয়া উপায় থাকে না! আওয়াজ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ!

gani adam

unread,
Dec 6, 2009, 9:02:24 AM12/6/09
to kobit...@googlegroups.com
বহুদিন পর আওয়াজ দিচ্ছি... আছি আমিও...

ভালো লাগছে। ভালো লেগেছে তপনদা'র ছন্দবয়ান, আরো ভালো লেগেছে ছোটোদের জন্য গৌতম রায়ের নিষ্ঠা। সলজ্জ স্বীকার করছি, অনেক আগে-- কবিতাকথার শুরুর দিকে এ বিষয়ে আমরা কথা বলবো বলে একদিন জানিয়েছিলাম তাঁকে।

আর হয়ে ওঠেনি। যেরকম অনেক ভালো কিছুই হয়ে ওঠেনা।


2009/12/3 Tapan Bagchi <drbagch...@gmail.com>

Tapan Bagchi

unread,
Dec 6, 2009, 12:54:44 PM12/6/09
to kobit...@googlegroups.com
গনি আদমকে শুভেচ্ছা তাঁর সুমধুর আওয়াজের জন্য।

gani adam

unread,
Dec 7, 2009, 9:09:27 AM12/7/09
to kobit...@googlegroups.com
ধন্যবাদ তপনদা'। দয়া করে একটু খেয়াল রাখবেন... (জ্বী না, আমার দিকে নয়, আমার নামের বানানটার দিকে।)


গনী আদম

2009/12/6 Tapan Bagchi <drbagch...@gmail.com>

Tapan Bagchi

unread,
Dec 7, 2009, 2:48:03 PM12/7/09
to kobit...@googlegroups.com
ধন্যবাদ, গনী আদম
Reply all
Reply to author
Forward
0 new messages