অন্য এক অবধূত

16 views
Skip to first unread message

Sohel Hasan Galib

unread,
Jul 23, 2009, 3:25:16 PM7/23/09
to কবিতাকথা
বঙ্গসাহিত্যে বজ্জাতিসজ্জাতির কেন্দ্র হিশেবে আজিজ মার্কেট তখন সুবিদিত। সেটা সম্ভবত ২০০২/০৩ সালের কথা। আজ যেখানে নালন্দা, তপ্ত মধ্যাহ্নে যেখানে এসি রুমে বসে আমরা কলা-দই খাই, তখন সেখানে এসব কিছুই ছিলো না। দিনান্তের শূন্য করিডোর হিশেবেই একে পেয়েছিলাম। আরেকটু দূরে উত্তর-পূর্ব কোণটাতে তখন সন্ধ্যা মানেই ছিলো সিদ্ধির আড্ডা। সিদ্ধাচার্যদের নামধাম আজ আর নাই বললাম। মাঝে মাঝে মাদল আমাকে জবর-দোস্তি করে ওখানে টেনে নিয়ে যেতো। কিন্তু আমি চিরকালই সিদ্ধিতে অনিপুণ। সাহিত্যের চেয়ে সিদ্ধিচর্চাই যখন মুখ্য হয়ে উঠলো, তখন বাধ্য হয়ে মাদলেরও সঙ্গ ত্যাগ করলাম। অনেক পরে ও স্বীকার করেছে, আর কিছু না হোক ঐ আড্ডায় অন্তত গাঁজা খাওয়া শিখেছি।

মূলত, দোতলায় তখন যাওয়াই হতো কম। ঐ দিনান্তের শূন্য করিডোরে প্রথম বসেছিলাম 'শিরদাঁড়া'র আড্ডায়। আমাদের প্রিয় মজনু ভাই তখনও কট্টর ধারা ত্যাগ করেন নাই। এবং তখনও তিনি শূন্যের কবিদের অঘোষিত গুরু হয়ে ওঠেন নাই। তবে আমি আর মাদল গোপনে, মনে মনে 'বয়াত' গ্রহণ করেছি। ঐদিন উনার অনামাঙ্কিত কাব্যের খণ্ড-পাণ্ডুলিপি পাঠ-অনুষ্ঠান ছিলো। উপস্থিত ছিলেন মুজিব মেহদী, শামীম সিদ্দিকী, সুহৃদ শহীদুল্লাহ, আর যেন কে কে। অনুষ্ঠান শেষে এসে হাজির হয়েছিলেন বিপ্লবী নেতা ফারুক ওয়াসিফ, বাউল-অবতার সাইমন জাকারিয়া। সকলেই কবিতার প্রশংসা করেছিলেন। সত্যিকারের বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছিলেন কেবল শামীম সিদ্দিকী। তিনি একটা ভৌতিক সমালোচনা হাজির করলেন। তা এতই ভৌতিক যে আজ আর মনে নাই। তারই প্রতিক্রিয়ায় কিংবা সমাপনী বক্তব্যে মজনু শাহ প্রসঙ্গত 'পুলিপোলাও' কাব্যের রেফারেন্স টেনে আনলেন। পরস্ব পংক্তির স্বীকরণ নিয়ে কথা। একটা চূড়ান্ত সাফল্যের নমুনায় কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের প্রশংসা আক্ষরিক অর্থেই সেদিন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো
পঞ্চমুখে। একথাও বলা হয়েছিলো, সুব্রত দুঃসাহসিক দুর্গম পথ অবারিত করে দিলেন।

আমরা তখন সদ্য 'পুলিপোলাও' পাঠ শেষ করেছি। কিছুদিন আগেও জানতাম না এই শব্দের মানে কী। 'পিঠা' জাতীয় কিছু হবে-টবে---এমনই ভেবেছি। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আসবার পর 'ক্রান্তিক' পত্রিকার জন্য মাদলকে বললাম একটা রিভিউ পাঠাবার জন্য। ও তখনও ক্যাম্পাসে, এক ইয়ার ড্রপ দিয়ে ছাত্রত্বের আয়ু বাড়িয়ে নিয়েছে। পরীক্ষার ফাঁকে বেশ দ্রুত, সংক্ষিপ্ত একটা লেখা ও পাঠালো। পড়ে দেখলাম, স্বস্তিবচনের হিম শ্বাস উঠে আসছে। সম্পাদকীয় বদামির জায়গা থেকে বললাম, "দোস্ত, তোমার মনে কোনো সংশয় নাই?" ও তখন ছোট্ট একটা চিরকুট পাঠালো, তাতে লেখা, 'সমালোচকের সংশয়'। বলল মূল আলোচনার শেষে জুড়ে দিতে।

আজ প্রায় ৬ বছর পর 'ক্রান্তিক' পত্রিকাটি আমার এক ছাত্রবন্ধুকে দিতে গিয়ে নজর পড়লো লেখাটির উপর। ইচ্ছে হলো কবিতাকথা'র বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে। তাই এখানে তুলে দিলাম।




মাদল হাসান

পুলিপোলাও ।।  সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ : অন্য অবধূত

ঐতিহ্য বিনাশ্রমে আসে না নিশ্চয়।
শ্রমিকের শ্রমে তাহারে অর্জিত হয় ॥


যে হাহাকার রব তিনি কয়েক কোটি বহুমুখী সুড়ঙ্গের কোনো একটিতে ঠেলে দিয়েছিলেন তা-ই ফিরে এসেছে প্রতিধ্বনিসংগীত হয়ে। তুমুল ঐতিহ্যপীড়িত জ্বরে একটানা প্রলাপের মতো এই গান, যে গানে জাতিস্মরের শক্তিতে ফিরে পাওয়া যায় পূর্বজনের কর্মসুর। T. S. Eliot সেটাকে বলেছিলেন :

No poet, no artist of any art, has his complete meaning alone. His significance, his appriciation is the appriciation of his relation to the dead poets and artists. You cannot value him alone ; you must set him, for contrast and comparison, among the dead. I mean this is a principle of aesthetic, not merely historical, criticism. The necessity that he shall conform, that he shall cohere, is not one-sided ; what happens when a new work of art is created is something that happens simultaneously to all the works of art which preceded it.         
(Traditioin and the Individual talent)

আহরণ এবং আত্মসাতের ক্ষেত্রে তিনি সংস্কারহীন। চর্যা থেকে শুরু করে বৈষ্ণব পদাবলী, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, মাইকেল, লালন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ---সবকিছু তিনি আত্মস্থ করেছেন অথবা গোগ্রাসে অথবা দৈত্যগ্রাসে অথবা দেবগ্রাসে গিলেছেন এবং জটিল জারণের শেষে উগরে দিয়েছেন এবং আশ্চর্য, একটুও দুর্গন্ধ বেরুলো না, বরং যে প্রক্রিয়ায় মৌমাছি মধু বানায়, আমরা পান করি এবং যে প্রক্রিয়ায় জারিত খাবার পাখিরা উগরে দিলে অমৃতজ্ঞানে ছানাগুলি খায়, আমরা তেমনি তৃপ্ত হলাম।

যে শৈব শক্তির গুণে সমস্ত উঞ্ছবৃত্তি উৎকট হলো না, এবং অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্য অমৃতের যৌগে যে বিষ হয়, তেমন সম্ভাবনার সৌজন্যকে পাশ কাটিয়ে অথবা বিষ হোক বা হতে পারে এমন কঠিনের জিঘাংসাকে জেনে তিনি নীলকণ্ঠ হয়েছেন। এ কারণেই তিনি সহজেই বলতে পারেন :

নানা কাচ-বাক্শ মৌলিল রে,
 গগনেতে লাগিল রে ছাদ---

অথবা মাইকেলী ধাতু ও ক্রিয়াপদের পদে নিজেকে উৎসর্গ করেই তিনি উত্তীর্ণ। অন্যদিকে ‘পুলিপোলাও’-এর সবকটি সনেট বা চতুর্দশপদী পড়ে মনে হয় যেন মাইকেলের ‘বঙ্গভাষা’ আর ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাদুটির প্রলম্বিত পথেই তিনি অন্য এক অবধূতের মতো নিঃশঙ্ক হেঁটে যাচ্ছেন।

শব্দ ব্যবহারের
ক্ষেত্রে তিনি দেশী বিদেশী সব শব্দই যথেচ্ছ এবং সংস্কারহীনভাবে ব্যবহার করেছেন, আর অন্যসব প্রতিষ্ঠিত কবির যে সব শব্দ তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো প্রায়, সেগুলোর যৌক্তিক-জারিত-জীবন দিয়েছেন, যেমন : নজরুল, সুধীন দত্ত-ব্যবহৃত ‘পল্বল’ বা জীবন দাশ-ব্যবহৃত ‘সঙ্ঘারামে’ শব্দটি বা মাইকেলের কিছু কিছু শব্দ।
মাইকেলের চতুর্দশপদীর প্রলম্বন যেমন ‘পুলিপোলাও’-এ ঘটেছে তেমনি ঈশ্বরগুপ্তের ‘স্বদেশ’ কবিতার একটি পংক্তি গোমেজের ব্যক্তিজীবনে অমোঘ সত্যে পরিণত হয়েছে :

স্বদেশের প্রেম যত          সেইমাত্র অবগত,
বিদেশেতে অধিবাস যার।

বাঙালি মুসলমানের দেশে সংখ্যালঘুর যে অস্তিত্বসংকট তাই যেন তাকে দ্বীপান্তরিত করেছে। আজকের বাঙালি মুসলমান যে হিন্দু থেকে বৌদ্ধ এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু বা বৌদ্ধ থেকে মুসলমান বা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ থেকে খৃস্টানে পরিণত হয়েছে---এ কথাগুলো অনুক্ত রয়ে গেলেও তা আত্মিক আবহে যে রয়ে গেছে, তা স্পষ্ট। তাই তাকে বলতে হয় :

কয় কী ! গাঞ্জুট্টা না কি ! আমি কবে কারুর ছিলাম ?---বিমাতার ?
আমার মা ছিল ? বোন ? ভাই ? বাপ ? পিণ্ডলোভী চৌদ্দ পুরুষ ?
মূলহীন কাঁটালতা নই আমি যিশুর মাথার ?
ঈশ্বরের শিশ্ন থেকে সরাসরি খ'শে-পড়া স্বতশ্চল ক্রুশ ?
অজাত-আত্মীয়, তথা অজাত নিজেই ?
আমার শূন্যতা কেন পুশ্ ক’রে না-যাব রে সকল বীজেই ?             (৩৮)


গোমেজের এই অস্তিত্বসংকটের বিচিত্র প্রশ্নের উত্তরে বলতে চাই :

এই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কালে যে শূন্যতার শেকলে আপনি বন্দি,
সেখানে আপনি একা নন, বরং আমরাও আপনার সঙ্গী।


স্বদেশপ্রীতি-ঐতিহ্য-অস্তিত্ব-রাজনীতি-র সকল আধার ছাপিয়ে যে আধেয় উপচে ওঠে তা ‘পুলিপোলাও’-এর ভাষা, তবে ভাষাও গুহ্য অর্থে আধার কি-না, সে প্রসঙ্গ এখানে না তুললে বলা যায়, গোমেজ আক্ষরিক অর্থে মৃত সব কবির ভাম্পায়ার জাগিয়েছেন, যে ভাষার কালোযাদুর তন্ত্র-মন্ত্র যেন ‘মৃত শত কিশোরীর কঙ্কণের সুর’, যা বহুদূর থেকে ভেসে আসে এবং জাগ্রতকে করে সম্মোহিত আর মৃতকে তুলে আনে গোর থেকে। এই ভাষার ঐকতানে মৃত কবিরা জেগে উঠে অগ্নিনৃত্যে রত হয় আর মন্ত্রের মতো বলে, তোমার মধ্যে আমরাও আছি। ফলে পুরো বাংলা কবিতার প্রবাহের মধ্যে ফানা হয়ে যাওয়ার তুরীয় রস গোমেজের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। ফলে গোমেজের কবিতা পড়তে গিয়ে আধার ও আধেয়ের দ্বৈতাদ্বৈত রূপটির কথাই বারবার মনে হয়। বাংলা কবিতার ধারাকে যদি একটি ওয়ান ডে ক্রিকেট ম্যাচের সাথে তুলনা করা যায়, তাহলে যে সব কবিরা পরে ব্যাট করতে এসে অবদান রাখতে চান, তাদেরকে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মতো খেলতে হয়, স্লগ ওভারে খেলা ব্যাটসম্যানদের মতো দুএকটা চার ছক্কা মারলেই শুধু তাদের চলে না, কারণ তারা এমন একটা সময়ে ব্যাট করতে এসেছেন যখন বিশ থেকে চল্লিশ ওভার পর্যন্ত খেলতে হবে এবং পনেরো ওভারের ফিল্ডিং সুবিধাও এখানে নেই ; ফলে এ
ক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হলে তাকে বাছাই করা কিছু শট খেলতে হয় আর অনেক বেশি নির্ভর করতে হয় সিংগেলস এন্ড টুজ-এর উপর। এ ক্ষেত্রে অগ্রজ ওপেনারদের ভালো পারফরমেন্সের সুবিধা তারা লাভ করতেই পারেন, কিন্তু ম্যাচ উইনিং পারফরমেন্স তাকেই দেখাতে হয় অথবা ধৈর্য ধরে ম্যাচ বের করে আনতে হয়।
আবার কবিকে যদি টেস্ট ম্যাচের বোলার হিশেবে কল্পনা করি তবে অবশ্যই তাকে লাইন ও লেংগথ বজায় রেখে বল করতে হবে, কিছু বাউন্স, শটপিচ, ফুলটস হতে পারে, তবে তা অবশ্যই উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হতে হবে, সবই ভাষাকে আত্মস্থ করার জন্য। তাকে অবশ্যই (ফর্মে লিখলে) ফর্মের ফিল্ডিং মেনে বল করতে হবে।

গোমেজ এমনভাবে সনেট বা চতুর্দশপদী ফর্মটাকে আত্মস্থ করেছেন যে তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি সেই বেয়াড়া বালক, যে চতুর্দশপদীর বিস্ময়-বেলুন হাতে নিয়ে মুক্তক অক্ষরের স্বাধীন ফুঁ দিয়ে তার ইচ্ছামাফিক আকার দিচ্ছেন। এ
ক্ষেত্রে যখন তার দম যেভাবে সায় দিচ্ছে সে ভাবেই তিনি তা কাজে লাগাচ্ছেন।

গোমেজ যে আঙ্গিক নিয়ে এভাবে মাতলেন, তার অন্তর্গত যুক্তি হয়তো গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের ঐ আলোকে যে, খাদ্য পরিবেশন একটা বড়ো ব্যাপার এবং সঠিক পরিবেশন সবকিছুকে সুন্দর করে তোলে। আঙ্গিক, ভাষা-কাঠামো, ছন্দ-কাঠামো এবং অন্ত্যমিল সবকিছুর সম্মিলিত লীলা দেখে আমাদের শুধু গোপীভাব জাগে। তবে যে ‘অস্তিত্বসংকট’ এই কাব্যের সারাৎসার তা হয়তো একদিন গোমেজের মনোজগতে থাকবে না। সেদিন হয়তো তিনি স্থায়ীভাবে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে রবীন্দ্রনাথের গানের বিস্তার ঘটিয়ে বলবেন : 
 
বড়ো আশা ক'রে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও,
ফিরায়ো না জননী ।




সমালোচকের সংশয়


সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ঐতিহ্যের অন্বেষণে নেমেছেন সত্য, কিন্তু পূর্ববর্তী কবিদের পোষকদেহ হিশেবে কতদিন ব্যবহার করবেন ? তার পরপংক্তিভোজ রসপ্রদ, কিন্তু তা যদি চিরদিনের স্বভাব হয়, তাহলে অবশ্যই নিন্দার্হ। আশা করছি তিনি পরগাছা না হয়ে বাংলা কবিতার অন্যতম বটবৃক্ষই হবেন।


Reply all
Reply to author
Forward
0 new messages