আমাদের পদ্মভূষণ
==========
০১.
"... দেশ এখন ফের পাল আকীর্ণ। 'সব শেয়ালের এক রা'। 'রজতজয়ন্তী' নামে আওয়ামী লীগকে জনপ্রিয় করা, মিথ্যা ভাষণে সত্য ইতিবৃত্ত রচনার প্রয়াস এখন মুখ্য। আমাদের সাহিত্যিক সাংবাদিক শিক্ষক উকিল ডাক্তার বুদ্ধিজীবীরা সবাই লাভে লোভে স্বার্থে বেহায়া বেশরম হয়ে নগ্নভাবে পা চাটা চাটুকার হয়ে আওয়ামী লীগে ছুটে গেছেন। আত্মসত্তার মর্যাদাবোধহীন এমন শিক্ষিত জ্ঞানী জন অন্যত্র আছে বটে। শওকত ওসমান ও কামাল লোহানী হচ্ছেন বকের মতো সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী ও নগদজীবী। মুনির চৌধুরীর ভাই কবীর চৌধুরীও মুনীর চৌধুরীর মতোই সুবিধেবাদী, কিন্তু মগজে-মননে স্থূল সুবিধাবাদী। আমি যাকে দেশগৌরব কবি বলে জানি ও প্রচার করি, সেই শামসুর রহমান এমন নগ্নভাবে নগদজীবী আওয়ামী দালাল হলেন সার্বক্ষণিকভাবে - এ বড় লজ্জার ও বেদনার বিষয় আর ন্যাক্কারজনক।
আর আমাদের অজাতশত্রু গুণে-গৌরবে অত্যন্ত জনপ্রিয় ড. আনিসুজ্জামান কি যাদুকরী নীতি ও আদর্শে একাধারে ও যুগপৎ বিরোধী রাজনীতিক দলের প্রতিবাদী বিবৃতির লেখক ও স্বাক্ষরদাতা, বক্তা হয়েও সরকারের কাজে-কমিটিতে, রেডিও-টিভিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ব্যক্তি হিসেবে গণ্য ও আস্থাভাজন থাকেন। আবার একাধারে ও যুগপৎ মার্কিন ও রাশিয়ার প্রিয় ও আস্থাভাজন থাকেন তা ভেবে পাইনে। তিনিই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনন্য পুরুষ। তার জনপ্রিয়তাও অসামান্য। তার বক্তৃতার কোন শব্দ বা বাক্যই আজো কারো আপত্তির বা অপছন্দের কারণ হয়নি। ড. আনিসুজ্জামান হচ্ছেন পদ্মপত্র বা কচুপাতার মতো চরিতের লোক। জলেতে নামবে, কিন্তু গায়ে জল লাগাবে না॥" - ০৯/১২/১৯৯৬
— আহমদ শরীফ / আহমদ শরীফের ডায়েরি : ভাব-বুদ্বুদ ॥ [ জাগৃতি প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ । পৃ: ১৩০-১৩১ ]
০২.
"... গ্রেফতারের সময়কার পরিস্থিতি সম্পর্কে কাজী গোলাম মাহবুব বলেন, -
সর্বদলীয় কমিটির শান্তিনগর বৈঠক সম্ভবত: ৭ই মার্চ (১৯৫২) অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তোয়াহা, অলি আহাদ, মুজিবুল হক, মীর্জা গোলাম হাফিজ ও আমি উপস্থিত ছিলাম। মূল আলোচনার পর তোয়াহা একটা বিষয় উত্থাপন করে কথা বলতে থাকলেন। তার ফলে বৈঠক বিলম্বিত হতে থাকলো। একটা সন্দেহের আবহাওয়া ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছিলো এবং অন্যরা অধৈর্য হয়ে উঠেছিলো। আন্দোলনের (ভাষা আন্দোলনের) ভবিষ্যৎ বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা এর পূর্বেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বৈঠক প্রায় ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট স্থায়ী হয়েছিলো। তারপর বাড়ীটি পুলিশ কর্তৃক ঘেরাও হয়ে গিয়েছিলো এবং আমি ছাড়া অন্য সকল উপস্থিত সদস্যই গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিলেন। ঘেরাও হয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে আমি একটি আলমারীর উপর চড়ে সেখানে রাখা একটি হোল্ডঅলের ভিতর নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলাম। পুলিশ আমার কোন পাত্তা করতে পারেনি। প্রায় এক মাস পর এপ্রিলের ৭ অথবা ৮ তারিখে আমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পন করি। আমার মনে হয় আমাদেরকে ধরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আনিসুজ্জামানের (পরবর্তীকালে ডক্টরেট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) হাত ছিলো॥"
— পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি / বদরুদ্দীন উমর ॥ [ বইঘর - ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৫ । পৃ: ৪৫০ ]
০৩.
"... ছয় দফার প্রণেতা কে, এই নিয়ে অনেক জল্পনা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন সিভিল সার্ভিসের কয়েকজন সদস্য এটা তৈরি করে শেখ মুজিবকে দিয়েছিলেন, কেউ কেউ সে কৃতিত্ব কিংবা দোষ দিয়েছিলেন কয়েকজন সাংবাদিককে। তাদের পেছনে কোন শক্তি কাজ করছিল, সে বিচারও হয়েছিল। প্রথমে উঠেছিল ভারতের নাম। কিন্তু পাকিস্তান হওয়া অবধি তো দেশের বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ভারতের প্ররোচনা বলে। পরে বড়ো করে যে নাম উঠলো, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব এবং ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্টের বন্ধুত্বের কারণে পাকিস্তান ভাঙার উদযোগ নিচ্ছে মার্কিনরা, এমন একটা ধারণা খুব প্রচলিত হয়েছিল। আমরা যারা একটু বামঘেঁষা ছিলাম, তারা এই ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছিলাম। ফলে, ফেডারেল পদ্ধতি ও স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষপাতী হলেও ছয় দফাকে আমরা তখন গ্রহণ করিনি। আমরা আরো শুনেছিলাম যে, পাকিস্তান ভাঙতে পারলে পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি করতে দেওয়া হবে; সুতরাং এ কাজে মার্কিনদের উৎসাহ তো থাকবেই॥"
— ড: আনিসুজ্জামান / কাল নিরবধি ॥ [ সাহিত্য প্রকাশ - ফেব্রুয়ারী, ২০০৩ । পৃ: ৪২৮ ]
০৪.
" ... ঢাকা যে মুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে, সেকথা কেউ মুখ ফুটে বলেননি আমাকে। আশপাশ থেকে আভাসে-ইঙ্গিতে আমি তা জেনে নিয়েছিলাম। এই বাস্তবতা একটু একটু করে সঞ্চারিত হয়েছিল আমার মনে এবং লেখায়। আমি অল্প কয়েকটি শব্দের বাক্যে, অল্প কয়েকটি বাক্যের অনুচ্ছেদে, অল্প কয়েকটি অনুচ্ছেদের একটি বক্তৃতার খসড়া তৈরি করলাম। বেশি কথা বলিনি। সবটা মিলে ফুলস্ক্যাপ কাগজের এক পৃষ্ঠার কম।
লেখা শেষ করে মুরশিদ সাহেবকে দিলাম। তিনি পড়ে তাজউদ্দীনকে দিলেন।
তাজউদ্দীন অস্ফূটস্বরে বললেন, 'বেশি ছোট হয়ে গেল না?'
আমি বললাম, 'আমার তো মনে হয়, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্যে ওই যথেষ্ট। দেশবাসীর উদ্দেশে আপনাকে তো অনেক কাজের কথা বলতে হবে। দু-একদিন পরে না হয় বড় বক্তৃতা দেবেন একটা। আজ বরঞ্চ কম কথা বলুন।'
প্রধানমন্ত্রী আর কিছু বললেন না। কী যেন ভাবতে থাকলেন। তারই মধ্যে লোকের আনাগোনা। খসড়া চূড়ান্ত হলো না।
খানিক্ষণ পরে একটা টেলিফোন এলো - দিল্লি থেকে। তাজউদ্দীন কথা বললেন। তারপর আমার হাতে রিসিভার দিয়ে বললেন - লিখে নিন।
বোঝা গেল, ওই প্রান্ত থেকে একজন লিখিত কাগজ পড়ছেন। তিনি যেমন বললেন, আমি তেমনি লিখে নিলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের খসড়া।
খুব অবাক হলাম। এতকাল তো আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ভারতীয়দের কেউ লিখে দেননি, তাহলে এখন কেন? তাছাড়া ওতে এমন কোন কথা নেই, যা আমরা কেউ লিখতে পারতাম না।
লেখা শেষ করে ধন্যবাদ জানিয়ে টেলিফোন রেখে দিলাম। খসড়াটা দিলাম তাজউদ্দীনের হাতে। তিনি তাতে একবার চোখ বুলোলেন, খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লেন বলে মনে হলো না।
আমার খসড়াটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। খানিক পরে সারওয়ার মুরশিদ ও আমি একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম। ঘরের বাইরে পা দিয়ে উনিই প্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন ইংরেজিতে : তবে কি আমরা নতুন বন্ধনে জড়াতে যাচ্ছি নিজেদের?"
— ড: আনিসুজ্জামান / আমার একাত্তর ॥ [ সাহিত্য প্রকাশ - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭ । পৃ: ১৮১ ]
০৫.
"... আনিসুজ্জামান সাহেব আমার সমালোচনা করেছেন, কারণ আমি বলেছি বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা মুসলিম স্বাতন্ত্র্য-চেতনা ফিরে আসছে। তিনি বলেছেন, এটা বলছি, কারণ আমি পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন।
... আনিসুজ্জামান সাহেব আমাকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ১৯৭১ সালে আমি রাজশাহী ছেড়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম কেন? কিন্তু আমিও কি তাকে প্রশ্ন করতে পারি না, তিনি ১৯৪৭-এর পর ভারত থেকে তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় চলে এসেছিলেন কেন? তিনি তো পূর্ব বাংলায় জন্মগ্রহণ করেননি?
... তিনি কলকাতায় গড়েছিলেন এ দেশ থেকে কলকাতায় যাওয়া গায়ক-গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে একটি দল। তিনি তাদের নিয়ে ঘুরেছিলেন সারা উত্তর ভারতে। তার লক্ষ্য ছিল নাচ-গান-অভিনয়ের মধ্য দিয়ে উত্তর ভারতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ইন্দিরা গান্ধী যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার পক্ষে জনমত গঠন। এ সময় উত্তর ভারতে জনমত বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনুকূলে ছিল না। তারা মনে করছিলেন, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যেয়ে ভারতের উচিত হবে না কোনো বড় রকমের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। কেননা যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে হতে পারে একটি পক্ষ। যুদ্ধ কেবলই যে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সীমিত থাকবে, তা মনে করা ভুল হবে। যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারে একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ, যা আর থাকবে না ভারতের নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে একটি স্বীকৃত রাষ্ট্র। পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে সেটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। তাতে ভারতের হস্তক্ষেপকে আন্তর্জাতিক সমাজ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে তারা চাইবে না ভেঙে দিতে।
জানি না আনিসুজ্জামান তার দল নিয়ে উত্তর ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে জনমত গঠনে কতটা সাফল্য পেয়েছিলেন। কেননা, বাংলা গান উত্তর ভারতে কেউ বোঝে না। সুরের দিক থেকেও পছন্দ করে না। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘জনগণমন’ গান পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের আর সব প্রদেশে গাওয়া হয় হিন্দি অনুবাদে। তাই বাংলা গান দিয়ে লোক জাগানো সম্ভব নয় উত্তর ভারতে। আনিসুজ্জামান সাহেব ও তার নাচ-গান-অভিনয়ের সাথীরা ভালোই ছিলেন ভারতে। তারা ইন্দিরা গান্ধীর সৌজন্যে ভালো খেয়েছেন, পরেছেন এবং থেকেছেন ভালো হোটেলে। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০-১২ জন অধ্যাপক গিয়েছিলাম কলকাতায়। এদের মধ্যে কয়েকজন পড়েছিলেন দারুণ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে। অনেক অধ্যাপক আসতেন আমার কাছে। তাদের সবারই প্রশ্ন ছিল, কবে নাগাদ দেশে ফেরা সম্ভব হবে? আনিসুজ্জামানের প্রশ্নের উত্তরে এখানে এটুকুই বলতে পারি॥"
— এবনে গোলাম সামাদ / একজন পদ্মভূষণের চিন্তা-বিভ্রাট ॥ [ দৈনিক নয়া দিগন্ত - ৩০ জানুয়ারি ২৯, ২০১৬ইং ]
০৬.
"... আমার জন্ম কলকাতায়, এখানেই থেকেছি পার্ক সার্কাসে। রশীদ আলী দিবসে স্কুলের ক্লাস বর্জন করে সভায়-মিছিলে যােগ দিই। এখানেই ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখি : আমার চোখের সামনে আমাদের অবাঙালি গােয়ালা আর অজ্ঞাতপরিচয় একজন যুবক খুন হয়ে গেল প্রবীণেরা চেষ্টা করেও গােয়ালাকে বাঁচতে পারলেন না। অভিনেতা ছবি বিশ্বাসসহ আমাদের হিন্দু প্রতিবেশীরা পুলিশের সাহায্যে পাড়া ছেড়ে চলে গেলেন নিরাপদ আশ্রয়ে, আমাদের অনেক আত্মীয় হিন্দুপ্রধান এলাকা থেকে একইভাবে আমাদের এলাকায় এসে পৌঁছােলেন। শিখদের তখন গণ্য করা হতাে হিন্দুর জঙ্গি অংশ হিসেবে। গুজব রটলাে, শিখেরা পার্ক সার্কাস আক্রমণ করতে আসছে। আমাদের সকলের বাড়ির ছাদে ইট-পাটকেল আর সােডা ওয়াটারের বােতল জড়াে করা হলাে ওই আক্রমণ প্রতিরােধ করার জন্যে। শিখেরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসেনি, তবে পরবর্তী দু-বছর যখনই ম্যালেরিয়ায় ভুগেছি, তখনই জ্বরের ঘােরে দেখতাম, শিখ আসছে। বিহার রিলিফ ফান্ডের জন্যে টাকা তুলে আমি মুকুল ফৌজ থেকে পুরস্কৃত হলাম এবং আমার আবক্ষ প্রতিকৃতিসহ সেই সুকৃতির সংবাদ দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হলাে।
আমাদের পরিবারের সকলেই ছিলেন পাকিস্তান-আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক। কিন্তু ভারত-বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে যে বঙ্গবিভাগ হতে যাচ্ছে, তা জেনে তাঁরা মুষড়ে পড়লেন। বঙ্গবিভাগের জন্যে তাঁরা দায়ী করলেন মূলত হিন্দুর একগুঁয়েমিকে। আমার বাপমায়ের পৈতৃক বাস চব্বিশ পরগনা ভারতভুক্ত হওয়ায় বাউন্ডারি কমিশনে ‘আমাদের দিকটা ঠিকমতাে তুলে না ধরার দোষ দিলেন মুসলিম লীগকে। আমার আব্বার বয়স তখন ৫০ বছর, জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছিলেন কলকাতায়, তাঁর নিজের শহরের মায়া ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসতে তাঁর মন সরছিল না। তার ওপর, পদ্মার ওপারে বসবাসের চিন্তা তাঁর কাছে ছিল দুঃস্বপ্নের মতাে। আমার মা কিন্তু বারবার বলতে থাকলেন যে, তাঁদের দুই ছেলের ভবিষ্যৎ যদি থাকে, তবে তা পাকিস্তানেই আছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে —আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি — আমরা কলকাতায় পাট চুকিয়ে খুলনায় চলে এলাম। খুলনায়, কারণ জায়গাটা কলকাতার কাছে, সেখানে। আমাদের অনেক আত্মীয়স্বজন আছে, আর পাকিস্তান যদি না টেকে, তাহলে কলকাতায় ফিরে যাওয়া সেখান থেকে সহজ হবে। আমার দুই পিতৃব্যের মনে কিন্তু গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা একবারও মনে হয় নি।
১৯৪৮-এর ডিসেম্বরে আমরা চলে এলাম ঢাকায় — পরে এটাই পরিণত হয় আমার শহরে। ১৯৫০ সালে সীমান্তের দু-দিকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে গেল। বােঝা গেল যে, দেশত্যাগ সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোনাে সমাধান করতে পারেনি। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি — তখন মনে আরাে কিছু প্রশ্ন জাগলাে। বাংলা সাহিত্য আমার প্রিয় বিষয় বলে তাতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ছায়াপাতটা অনুসন্ধানের একটা তাগাদা অনুভব করলাম। আমি জানতাম যে, বাঙালি মুসলমানের মনে বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' সম্পর্কে প্রবল ক্ষোভ আছে। অরবিন্দ পােদ্দারের 'বঙ্কিম-মানস' পড়ার সুযােগ পাওয়ার আগেই ‘আনন্দমঠ ও বঙ্কিম-প্রসঙ্গ' নামে একটি প্রবন্ধ লিখে ফেললাম। কিছুকাল পরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ অনার্সের ছাত্র হয়ে যখন সবে ঢুকেছি, আমাদের এক সাহিত্য-সংগঠনের বিশেষ অধিবেশনে সেটা পড়েও ফেললাম। আমার প্রবন্ধ শুনে লােকসাহিত্যবিদ অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন এত উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে, সভাস্থলেই তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, আর কালবিলম্ব না করে আমাকে পাকিস্তান থেকে বহিস্কার করা কর্তব্য।
এরপর অন্যদিকটা যাচাই করার লক্ষ্যে 'বাংলা সাহিত্যে মুসলিম পুনর্জাগরণের পটভূমি' নাম দিয়ে একটা লম্বা প্রবন্ধ লিখি। সেটা পড়ে আমার বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই আমাকে এম এ পাশ করে গবেষণা করতে পরামর্শ দেন। এভাবেই ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে ইংরেজ আমলের 'বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা (১৭৫৭-১৯৪৭)' বিষয়ে গবেষণা করি। পরে আলােচ্য সময়সীমাটা কমিয়ে ১৯৪৭ এর বদলে ১৯১৮ করা হয়। ইচ্ছে করলে, আরম্ভের সময়টাও সঙ্কুচিত করে ১৮৭০ করতে পারতাম। তা যে করিনি তার একটা বিশেষ কারণ ছিল। পাকিস্তান-আন্দোলনের সময়ে এবং তার পরেও — অর্থাৎ ১৯৪০ ও ১৯৫০ এর দশকে — দ্বিজাতিতত্ত্বের সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা তারা বারবার বলতেন যে, 'পুঁথি সাহিত্য'ই (মুসলমানি বাংলা রচনা, বটতলার পুঁথি বা দোভাষী পুঁথি বলেও তা পরিচিত) আমাদের সাহিত্যের ঐতিহ্যের উৎস। এই পুঁথি-সাহিত্যের মাহাত্ম্যটা যে কী, আমি তা পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলাম।
'মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য' প্রকাশের পর তেত্রিশ বছর অতিবাহিত হলাে। এই সময়ের মধ্যে আমার চিন্তাভাবনার যে কোনাে পরিবর্তন হয়নি, তা নয়। বাংলার ও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রচলিত পর্ববিভাগ মেনে নিয়ে এ বইতে আমি প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের কথা বলেছি। পরে এই বিভাজন নিয়ে আমিই প্রশ্ন তুলেছি। আমার মনে হয় ইতিহাসের ইউরােপকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তিন যুগের এই ভাগটা করা হয়েছিল। ইংরেজ আমলে একটা নতুন ও সুদূরপ্রসারী জাগরণের উল্লেখ আমার বইতে আছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাটা বলা নেই যে, ঔপনিবেশিক পটভূমিকায় সর্বত্রই এ-ধরনের জাগরণের বড়রকম সীমাবদ্ধতা রয়ে যায়। এই জাগরণের ফলে সমৃদ্ধ সাহিত্যের বিকাশের কথা বলেছি; তার সঙ্গে একথাটাও বলতে পারতাম যে সে-সাহিত্য প্রধানত ইংরেজিশিক্ষিত পাঠকের জন্যে মূলত ইংরেজিশিক্ষিত লেখকের সৃষ্টি। রাজনৈতিক ইতিহাসের বর্ণনায়ও অনুরূপ বিচ্যুতি আছে। খিলাফত আন্দোলনের প্রতি কংগ্রেসের সমর্থন এবং অসহযােগ আন্দোলনে মুসলমানের ব্যাপক অংশগ্রহণকে আমি নবযুগের সূচনা হিসেবে দেখেছিলাম। কিন্তু খিলাফত আন্দোলন যে রাজনীতি ও ধর্মকে আগের চেয়ে বেশি কাছাকাছি নিয়ে এলাে, একথাটা একেবারেই বলা হয়নি। এরকম অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও এই বইয়ের মূল সিদ্ধান্তগুলাে এখনাে আমার কাছে যথার্থ বলে মনে হয়॥"
— আনিসুজ্জামান / মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য (১৭৫৭-১৯১৮) ॥ [ চারুলিপি - ফেব্রুয়ারি, ২০১২ । পৃ: ১৫-১৭ (চতুর্থ মুদ্রণের ভূমিকা) ]